নাফে নামতে না পেরে চোখে নোনাজল

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
  • ৪৩২ দেখা হয়েছে

টেকনাফ (কক্সবাজার):- কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীতীরবর্তী নাইট্যংপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেন (৪৩)। আট ভাইয়ের মধ্যে সাতজনের পেশা মাছ ধরা। নাফ নদীতে মাছ ধরেই চলত তাঁদের সংসার। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ বছর এই নদীতে মাছ ধরা বন্ধ।

তাহলে আবুল হোসেনরা টিকে আছেন কীভাবে? মাছ ধরা বন্ধ, কী করছেন এখন—এমন প্রশ্নে আবুল হোসেনের উত্তর, ‘জাইল্লারা মরে গেছি। আরা মাছ দরা ছারা হনো হাম গরি ন পারি। (আমরা জেলেরা মরে গেছি। মাছ ধরা ছাড়া আমরা তো কোনো কাজ পারি না।)’

আসলেই নাফ নদীপারের আবুল হোসেনদের চোখে এখন নোনা জলের ধারা। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার আগেই নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধের চিন্তার শুরু। উদ্দেশ্য মাদক ও চোরাচালানের লাগাম টানা। ওই বছরের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল শুরু হওয়ার পর ৩০ আগস্ট থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দুই মাস নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু এরপর সাড়ে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই নিষেধাজ্ঞা আর ওঠেনি। সময় না বাড়ালেও কোনো অজানা কারণে মাছ শিকারে নামতে পারছেন না বাংলাদেশি জেলেরা। যদিও মিয়ানমার প্রান্তে ঠিকই তাদের জেলেরা নিয়মিত মাছ আহরণ করছেন নাফ নদী থেকে। শুধু বাংলাদেশিদের জন্যই কড়াকড়ি।

নাফপারের জেলেদের দিন কাটছে তাই নিদারুণ কষ্টে। কেউ পেশা ছেড়ে চেষ্টা করছেন অন্য কিছু করার। শেষ সম্বল ট্রলার বিক্রি করে জীবনযাপনের পন্থাও খুঁজছেন কেউ কেউ। খরচ জোগাতে না পেরে অনেকে ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ করেছেন।

টেকনাফ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, উপজেলায় নিবন্ধিত জেলে আছেন আড়াই হাজারের বেশি। নাফ নদী বন্ধ রাখলে রোহিঙ্গা আসবে না। মাদক ও চোরাচালান বন্ধ হবে, এ কারণে মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই দুই মাসের আদেশ পরে আর বাড়ানো হয়েছে কি না, কেউ জানে না। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে। জেলেদের এই দুরবস্থার নিরসন জরুরি।

টেকনাফ উপজেলায় মাছ ধরার ঘাট আছে অন্তত ১০টি। গত শুক্রবার ভোরে নাইট্যংপাড়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়ে বসে আছেন বেশ কয়েকজন জেলে। তাঁদের একজন মোহাম্মদ উল্লাহ (৪১) স্থানীয় ভাষায় বললেন, ‘আরার পরিবার ন চলে, ইয়াবা বন্ধউ ন অর (আমাদের সংসার চলে না, ইয়াবা তো বন্ধ হয় নাই)।’

এবার অভিযোগের সুর মোহাম্মদের কণ্ঠে। তিনি জানালেন, ‘মিয়ানমারের প্রান্তে জেলেরা নিয়মিত মাছ শিকার করে। মাদক বন্ধের জন্য আমাদের নদীতে নামতে দিচ্ছে না। কিন্তু মাদক তো বন্ধ হয়নি। পুরো পরিবার এই কাজের ওপর নির্ভরশীল। সাড়ে পাঁচ বছর ধরে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। সরকার যেন আমাদের মুখের দিকে তাকায়।’

টেকনাফ সদর উপজেলার এমপির জেটি, হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোড়া, নাটমোড়াপাড়া এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচি প্রাং, লম্বা বিল, উলুবুনিয়ায় জেলেদের গ্রামগুলো ঘুরে একই চিত্রের দেখা মেলে। নদীতে নামতে না পেরে ঘাটে অলস পড়ে আছে মাছ ধরার নৌকা ও ছোট ট্রলারগুলো।

শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ার সরোয়ার কামাল তিন ছেলে ও চার মেয়ের বাবা। তিনি বললেন, ‘অভাবের হারণে আর জেরপোয়ারে স্কুলোত্তো লামাই ফালাইয়্যি। আরার ইচ্ছা আসছিল, আর পোয়াইন্দোরে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাইতাম। এহন আর স্বপ্ন নাই (অভাবের কারণে মেয়েদের স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে নিয়ে এসেছি। আমাদের ইচ্ছা ছিল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাব, এখন আর কোনো স্বপ্ন নেই।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির টেকনাফ উপজেলা সভাপতি আব্দুল সালাম বলেন, ‘প্রতিদিন গণমাধ্যমে দেখি নাফ নদী থেকে ইয়াবা, সোনা, অস্ত্র, এমনকি আইস নামের মাদকও উদ্ধার হয়। জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ রেখে তো প্রশাসন এসব বন্ধ করতে পারছে না। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে প্রশাসনে আবেদন করার পরেও কোনো সদুত্তর পাইনি।’

নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ রেখে মাদক চোরাচালান রোধ করা গেছে কি না, এমন প্রশ্নে টেকনাফের ২ বিজিবির কমান্ডিং অফিসার (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার আজকের পত্রিকাকে বলেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়েছে। মাদক পাচার রোধ বহুমাত্রায় কমেছে। মৎস্যজীবীদের পুনর্বাসনের বিষয়টি জেলা প্রশাসনের এখতিয়ার।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘নাফ নদীতে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আছে। এটা সাময়িক নিষেধাজ্ঞা ছিল, কেন এখনো চালু হয়নি তা খতিয়ে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions