ডেস্ক রির্পোট:- ‘ঘুমের মধ্যে এখনো আঁতকে উঠি। ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনাগুলো তাড়িয়ে বেড়ায়। ভাত খেতে দেওয়া হয়নি। দেড় মাস কার্টনের বিস্কুট খেয়েছি। যখন মরার পথে, তখন অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ফেলে রেখে যাওয়া হয়। এখন দেশে এসে অর্থ কষ্টে থাকলেও শারীরিক-মানসিক নির্যাতন থেকে রক্ষা পেয়েছি। জীবন নিয়ে প্রিয়জনদের কাছে ফিরতে পেরেছি, এটাই সান্ত্বনা…’
অশ্রুসিক্ত নয়নে কথাগুলো বলছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে গিয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, দালালের মাধ্যমে সৌদি যাই। তবে যারাই গৃহকর্মী হিসেবে যান, তাদের ওপর জুলুম চলে। অমানবিক পরিশ্রম, তারপরও মাসিক পাওনাটাও ঠিকমত দেয় না। নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসার সময় পারিশ্রমিকটুকু আটকে রাখে। বাধ্য হয়ে দুই বছর আগে দেশে ফিরে আসি।
আনোয়ারার মতো অনেক নারী বিদেশে বিভিন্ন সমস্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মুখ বুজে সহ্য করছেন। অনেকে আবার বিভিন্ন জটিলতার কারণে দেশেও ফিরতে পারছেন না।
মা চকলেট আর পোশাক নিয়ে শিগগিরই বাড়ি ফিরবেন, দিন পেরিয়ে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এ আশায় প্রতিদিন বসে থাকে ছয় বছরের রোজিনা। কিন্তু নানা বিপত্তির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডান থেকে ফিরতে পারছেন না তার মা শাহনাজ বেগম (৩০)। সেখানে জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও তিনি শঙ্কায় আছেন।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় গাজীপুর ইউনিয়নের দুধপাতিল গ্রামে শাহনাজের বাড়ি। সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে চার বছর আগে তিনি আদম বেপারির মাধ্যমে জর্ডানে যান। কিন্তু পাসপোর্টে লিপিবদ্ধ নামের সঙ্গে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নামে অমিল থাকায় ফিরতে পারছেন না। এ অবস্থায় ফিরলে দ্বিতীয়বার যেতে পারবেন না। জর্ডানে কয়েক মাসের পারিশ্রমিক জামানত রেখে তাকে ফিরতে হবে। তাই ফিরতে পারছেন না।
২০২০ সালের মার্চে পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে সৌদি আরব যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লুৎফা বেগম। গৃহকর্মী হিসেবে সেখানে কাজ করেছেন এক মাসের বেশি। নির্যাতনে টিকতে না পারায় তাকে পাঠানো হয় দেশটির সেফ হোম বা সরকারি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে প্রায় তিন মাস থাকার পর দেশে ফিরে আসেন তিনি।
ওই নারী জানান, সৌদি আরব যাওয়ার পর দুই বাসায় কাজ করতেন। তবে কোনো বাসায়ই খেতে পারতেন না। পুরুষ সদস্যদের আচরণ ভালো ছিল না। দেশে ফিরতে চাইলে তাকে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
এসব ভুক্তভোগী নারীকর্মীদের পরিবার জানায়, বিদেশে কাজ করতে গিয়ে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর বিচার চান তারা। এ বিষয়ে তারা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ ছাড়া যেসব কর্মী বিদেশে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েও দেশে ফিরতে পারছেন না তাদের ফেরাতে সরকারের সাহায্য কামনা করেন একাধিক পরিবার।
গত দুই বছরে বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড হলেও নির্যাতন ও প্রতারণার কারণে কমেছে নারীর কর্মসংস্থান। ২০২৩ সালে বিদেশে মোট কর্মী গেছেন ১৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে নারীকর্মী গেছেন ৭৭ হাজার ২৬৩ জন। এ ছাড়া গত বছর নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তিন হাজার নারীকর্মী।
সরকারি সংস্থার কাছে বিদেশ থেকে ফিরে আসা কর্মীদের কোনো হিসাব নেই । তবে যারা পাসপোর্ট হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আউটপাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) নিয়ে ফেরেন, তাদের হিসাব রাখে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক। বিমানবন্দরে কাজ করে এ ডেস্ক।
সূত্র বলছে, গত বছর বিভিন্ন দেশ থেকে খালি হাতে ফিরেছেন ৮৬ হাজার ৬২১ জন। এর মধ্যে নারীকর্মী আছেন ২ হাজার ৯০২ জন। সর্বশেষ ডিসেম্বরেও ফিরেছেন ২৪৯ জন নারী।
সচেতনতার অভাব, দালালের মিথ্যা প্রলোভন ও দক্ষতার অভাবে নারীরা নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সৌদিতে নারীকর্মী পাঠানোর আগে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না সেই নিয়ম। ফলে প্রতি বছর অনেক নারী দেশে ফিরে নির্যাতন-নিপীড়নসহ নানা অভিযোগ করছেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, নির্যাতনের পর তাদেরকে বাড়ি, হাসপাতাল বা রাস্তা থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে সৌদির রিয়াদে বাংলাদেশের যে দূতাবাস রয়েছে সেখানে তাদের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে থাকে নানাবিধ জটিলতা। দূতাবাস থেকে ঘটনাস্থল দূরে হওয়ায় অনেক সময় তারা যেতে চান না। এ ছাড়া ভুক্তভোগী নারীরা ভাষা জানেন না। ফলে তারা তাদের কর্মস্থলের ঠিকানা ও সমস্যা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেন না পুলিশ বা দূতাবাসকে।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (মিশন ও কল্যাণ অনুবিভাগ) মো. সারওয়ার আলম বলেন, ‘চুক্তিতে সৌদি গেলেও তা শেষ হওয়ার আগেই ফিরে আসছেন অনেকে। দেশে আসার আগে তারা দূতাবাসের সেফ হোমে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, যারা ভুক্তভোগী তাদের বিভিন্ন বাসা বা হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে উদ্ধারের পর তাদের সুরক্ষা দেয় দূতাবাস ও সৌদি পুলিশ। যেসব নারী নির্যাতনের শিকার হন তারা নিজেদের সমস্যা ভালোভাবে পুলিশ ও দূতাবাসের কাছে বলতেও পারেন না। এমনকি যেখানে কাজ নেন সেই বাড়ির ঠিকানা ও মালিকের নামও বলতে পারেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা দেশে আসার জন্য অস্থিরতা দেখান ও সমস্যা সমাধানের জন্য সময় নিতে চান না। ফলে দূতাবাস দেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হয়।
অনেক কর্মী বেতন বঞ্চিত হন, এ ক্ষেত্রে দূতাবাস কি ব্যবস্থা নেয়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সৌদি আইন অনেক কঠোর। চাইলেও বঞ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। দেশে আসার আগে তারা বেতন পেয়েছেন কি না পুলিশ জানতে চায়। তখন তারা বেতন নিয়ে কথা না বলে কাগজে স্বাক্ষর করে আসেন। দেশে আসার পর যখন আমাদের কাছে অভিযোগ করেন তখন আমরা ব্যবস্থা নিলে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে জানানো হয় যে, তারা বেতন বইতে স্বাক্ষর করে এসেছেন, কোনো পাওনা বকেয়া নেই।
নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হয়ে ফিরে আসা এ নারীদের নিয়ে আপনাদের কোনো পরিকল্পা আছে কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফিরে আসা অনেক নারী ওয়েল ফেয়ার সেন্টার প্রশিক্ষণ নিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন। এ ছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অনেক নারী ক্ষুদ্র ব্যবসাও করছেন।
এ বিষয়ে জজকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেন, ‘দেশের অভিবাসী আইন সংশোধন হয়েছে। তবে সেখানে নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি আলাদাভাবে গুরুত্ব পায়নি। ফলে বিদেশে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি, এখনো নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা।খবরের কাগজ