ডেস্ক রির্পোট:- উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘দক্ষতা’ দেখাতে পারছে না নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সংস্থাগুলো। চলতি অর্থবছরের আট মাসে এ মন্ত্রণালয়ের এডিপিভুক্ত ৩১টি প্রকল্প বাস্তবায়নে গড় অগ্রগতি মাত্র ১৩.৯৯ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ের ১০ হাজার ১৪৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দের মধ্যে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৪১৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
চারটি প্রকল্পে বরাদ্দের এক শতাংশ টাকাও ব্যয় হয়নি। অথচ জানুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি ২৭.১১ শতাংশ। ওই হিসাবে জাতীয় অগ্রগতির ধারে-কাছেও নেই নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। এমন অবস্থায় আজ এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা করতে যাচ্ছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। বর্তমান মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে এটাই এ ধরনের প্রথম সভা। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মোটা দাগে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির বড় কারণ ডলার সংকট। ডলার সংকটের কারণে সময়মতো এলসি খুলতে পারছেন না ঠিকাদাররা। যেমন: ২০২১ সালে নৌযান নির্মাণসংশ্লিষ্ট কার্যাদেশ দেওয়া হলেও ডলারের অভাবে এলসি এখনো খুলতে পারেনি। অপরদিকে অভিযোগ রয়েছে, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে গিয়ে দরপত্র আহ্বান ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়া।
এছাড়া ঋণভিত্তিক প্রকল্পগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ। সঠিক প্রক্রিয়ায় টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি ও দরপত্র মূল্যায়ন করতে না পারা এবং মূল্যায়ন দর প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি হওয়াসহ নানা কারণে দাতা সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ছাড়পত্র দিচ্ছে না। প্রকল্প পরিচালকরা দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারছেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টেন্ডার বাতিলও হচ্ছে। প্রকল্পের ঋণ খাতে বরাদ্দ কমে যাচ্ছে। তারা আরও জানান, চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত আরএডিপিতে প্রকল্প ঋণ খাতে বরাদ্দ কমেছে ৩ হাজার ৫৫১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। যদিও জিওবি খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৬৩১ কোটি টাকা।
প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি কম হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল সোমবার বলেন, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এর আগের বছরও একই অগ্রগতি ছিল। আমাদের অনেক ড্রেজিং সম্পৃক্ত প্রকল্প রয়েছে। মার্চ থেকে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হয়। সামনের মাসগুলোয় ওইসব প্রকল্পে অগ্রগতি অনেক বেড়ে যাবে।
অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত অনেক প্রকল্প রয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবকাঠামো নির্মাণকাজের মাসভিত্তিক অগ্রগতি হয়। কিন্তু জাহাজ কেনার মতো একক ক্রয়সংক্রান্ত টেন্ডারগুলোর মালামাল বুঝে পাওয়ার পরই সব বিল পরিশোধ করা হয়। জুনের মধ্যে প্রকল্পের অগ্রগতি বাড়বে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ৩২টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ১০ হাজার ১৪৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে এডিপিভুক্ত প্রকল্প ৩১টি। এর বাইরে পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলে ড্রেজিং সংক্রান্ত একটি স্কিম (নন এডিপি) প্রকল্প রয়েছে। ওই প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ৪৮১ কোটি টাকা।
বিআইডব্লিউটিএ, স্থলবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলা বন্দর, পায়রা বন্দর, বিআইডব্লিউটিসি, নৌপরিবহণ অধিদপ্তর, নাবিক ও প্রবাসী শ্রমিককল্যাণ পরিদপ্তর এবং বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি কর্তৃপক্ষ এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সবচেয়ে বেশি ১৪টি প্রকল্প রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ-এর। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি ৪৯৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয় করেছে সংস্থাটি, যা বরাদ্দের ২৬.৬৩ শতাংশ। পায়রা বন্দরের দুটি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০৯ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৩৮.৯৫ শতাংশ।
অপরদিকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে নাবিক ও প্রবাসী শ্রমিক কল্যাণ পরিদপ্তর, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। নাবিক ও প্রবাসী শ্রমিককল্যাণ পরিদপ্তর, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির দুটি প্রকল্পে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। চট্টগ্রাম বন্দরের আওতাধীন মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে অগ্রগতি ২ শতাংশের কম। এছাড়া মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চারটি প্রকল্পের অগ্রগতি ৫.৮০ শতাংশ।
যেসব প্রকল্পে অগ্রগতি নেই : নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে চারটি প্রকল্পে অগ্রগতি এক শতাংশের কম। সেগুলো হচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ-এর চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফ অংশের জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ, চট্টগ্রাম বন্দরের পশ্চাৎ সুবিধাসহ হেভি লিফট কার্গো জেটি নির্মাণ, মোংলা বন্দরের সহায়ক জলযান সংগ্রহ এবং সাউথ এশিয়া সাব রিজিউনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) ইন্টিগ্রেটেড ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প (স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ অংশ)।
ঋণ প্রকল্পে অগ্রগতি কম : সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্তত সাত প্রকল্প দাতা সংস্থার ঋণ সহায়তা নিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের অগগ্রতি তুলনামূলক কম। এর কারণ হিসাবে তারা জানান, ঋণসহায়তা প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে দাতা সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ। আবার কখনো কখনো টেন্ডার আহ্বান ও দরপত্র মূল্যায়ন কার্যক্রম এবং স্বচ্ছতা নিয়েও দাতা সংস্থাগুলো প্রশ্ন তুলে থাকে। প্রকল্প পরিচালকের যোগ্যতা ও দক্ষতার ঘাটতির কারণেও সমস্যা তৈরি হয়। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প। এ প্রকল্পের দুটি অংশের একটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং আরেকটি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করছে। দুই অংশের টেন্ডার আহ্বান ও দরপত্র মূল্যায়ন জটিলতায় অগ্রগতি দুই শতাংশের কম হয়েছে। আরএডিপিতে ২৯৯২ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। একই অবস্থা আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নৌবন্দর স্থাপন প্রকল্পে। এই প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণকাজের পুনঃদরপত্র আহ্বানে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি পাওয়া যায়নি। চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্পের অগ্রগতি ১২.৪৯ শতাংশ। বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ প্রকল্প-১ ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পেরও বাস্তবায়নে একই ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে।যুগান্তর