ডেস্ক রির্পোট:- যৌন হয়রানির অভিযোগে উত্তাল রাজধানীর স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যাণ্ড কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির আজিমপুর শাখার এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকের বিচার দাবিতে আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। রোববার হওয়া এই আন্দোলনে যৌন নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তদন্তে প্রাথমিক সত্যতা মেলায় অভিযুক্ত মুরাদ হোসেন সরকারকে আজিমপুর থেকে প্রত্যাহার করে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষকের শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। আর অভিযুক্ত মুরাদ হোসেন সরকার বিষয়টিকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলছেন। এর আগেও যৌন হয়রানির দায়ে আরেক শিক্ষককে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছিল।
যৌন নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত মুরাদ হোসেন সরকারের শাস্তি দাবি করে রোববার আজিমপুর প্রধান ফটকে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। এ সময় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হয়রানির শিকার এক শিক্ষার্থী বলেন, উনি আমার সঙ্গে জান্নাতে যেতে চান।
উনি বলতেন ওনার বয়স যদি আরেকটু কম হতো আর আমার বয়স যদি বেশি হতো তাহলে উনি আমাকে বিয়ে করতেন। উনি বলেন, আমার অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হলেও যেন আমি ওনাকে ভুলে না যাই। আমি ওনার কোচিংয়ে যেতাম। কোচিং শেষে উনি বলতেন এই কারণে, ওই কারণে একটু লেট করতে। সবাই যাবার পর উনি ছিটকিনি লাগিয়ে দিতেন। আমি একজন নৃত্যশিল্পী। স্কুলে প্রোগ্রাম থাকলে উনি বলতেন আমাকে শাড়ি পড়লে ভালো লাগে, লেহেঙ্গা পড়লে ভালো লাগে ইত্যাদি। উনি বলতেন, ওনার মেয়েদের খুব ভালো লাগে। মন চায় সারাদিন বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখতে।
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, প্রথমে তিনি ফ্লাইং কিস করতেন। এরপর গালে কিস করেন। এরপর জড়িয়ে ধরা শুরু করেন। আস্তে আস্তে যখন না বলি তখন তিনি বুঝতে দিতেন না যে এটি খারাপ ইন্টেশনে করছি। এরপর বলতেন, আমাদের দু’জনেরই ভুল। আল্লাহর কাছে মাপ চাইতে হবে। এগুলো স্কুলের কাউকে বললে আমার মান সম্মান চলে যাবে। এরপর বলতেন এগুলোর জন্য আমারো দোষ আছে। এগুলো বলে কনভিন্স করার চেষ্টা করতেন। যাতে কাউকে না বলি। এরপর জোড় করে লিপ কিস করা শুরু করতেন। যখন থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি তখন আরও জোর করা শুরু করতেন। উনি ওনার প্রাইভেট পার্টস দেখার জন্য জোর করতেন।
হয়রানির শিকার ওই শিক্ষার্থী বলেন, উনি আমাদের প্রথমে বাবা হিসেবে নিজেকে জাহির করতেন। দ্যাট হি ক্যান টাস অ্যাস এনি হয়ার এনি টাইম। আমি প্রথমে কাউকে বলতে চাইনি। কিন্তু এরপর না পেরে আমি মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি। তিনি বুঝতে পেরেছেন স্কুলে প্রশ্ন করা হবে। এর আগের দিন তিনি বাসায় এসে শাসিয়ে গেছেন। আমার মান সম্মান যেতে পারে। আমাকে টিসি দেয়া হতে পারে। পরদিন স্কুলে আমাকে ৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তখন আমি ওনার ভালো চাইতাম তাই প্রথম দেড় ঘণ্টা মিথ্যা কথা বলেছি। তখন বাকি ভিকটিমদের কথা আপারা আমাকে বলে যে, ওদের সঙ্গে একই কাজ হয়েছে। তখন আমি স্বীকার করি। আমার সঙ্গে যা হয়েছে এটা ওনাদের সঙ্গেও হয়েছে লুকিয়ে রাখার কিছু নাই। এরপর আমি সব কথা বলি। নিয়ম অনুযায়ী আমি অ্যাপ্লিকেশেন করি। আমাদের বলা হয় রিপোর্ট দেয়া হবে কিন্তু দুই তিন সপ্তাহ যাওয়ার পরও দেয়া হয় না। এরপর আমরা বিষয়টি ভাইরাল করার চেষ্টা করি।
অভিযোগ দায়েরকারী এই শিক্ষার্থী বলেন, আমরা চাই ওনার বিরুদ্ধে অ্যাটেম্প টু রেপ কেস দেয়া হোক। ওনাকে মেইন ব্রাঞ্চে নিয়ে আরও প্রমোশন দেয়া হলো। আমরা চাই ওনাকে বরখাস্ত করা হোক।
মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ৩ শিক্ষার্থী। ৩ শিক্ষার্থীর একজনের অভিভাবক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষক বিদ্যালয়ের পাশেই একটি ভবনে শিক্ষার্থীদের কোচিং করান। কয়েক মাস আগে সেখানে মেয়েকে ভর্তি করাই। এরপর কোচিংয়ের আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে মেয়েকে যৌন হয়রানি করেছেন। তিনি বলেন, মা মা করে বিভিন্ন অজুহাতে উনি ছাত্রীদের শরীর স্পর্শ করেন।
আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা মুরাদ হোসেনের বিচার চাই। উনি সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাকে প্রত্যাহার না তাকে বরখাস্ত করা হোক। তিনি কোচিংয়ে এডাল্ট জোক্স বলতেন। সেক্সুয়ালি এসল্ট করতেন। তিনি ক্লাস ফাইভ থেকে এইট এই সকল শিক্ষার্থীদের টার্গেট করতেন।
আরেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, এক্সট্রা ক্লাসের নাম করে হ্যারেজমেন্ট করেন। আমাদের ম্যানুপুলেট করে রাখা হতো। উনি বলতেন, উনি আমাদের বাবার মতো। উনি আমাদের সাইকোলজি বোঝেন। এসব করে ম্যানুপুলেট করে তিনি আমাদের সঙ্গেই চান্স নিতেন। এরকম অসংখ্য শিক্ষার্থী এসবের মধ্যদিয়ে গেছে। এরই কারণে সকলে প্রতিবাদ করছে।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও এসেছিলেন আন্দোলনে। প্রাক্তন এক শিক্ষার্থী বলেন, গার্লস স্কুলে পড়ছি আমাদের কেন নিরাপত্তা থাকবে না? তারা যে তাদের অভিভাবকদের কাছে বলবে সেই মানসিকতাটাও জন্মায় না। ব্রেন ওয়াশ করা হয়। এতটা ট্রমাটাইজ্ড করা হয়। আমিও শুরুতে বিশ্বাস করতে পারতাম না। প্রাক্তন যারা অনেকে এখন বলছে তারাও ভিকটিম হয়েছিল, তারাও মুখ খুলতে পারেনি।
সাদেকুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, বাচ্চারা আজ সড়কে আন্দোলন করছে। আমরা চাই শিক্ষকদের হিমালয়ের মতো সম্মান করুক। কিন্তু আমরা এখন বাচ্চাদের নিয়ে শঙ্কিত। মনে হচ্ছে বাচ্চাদের মৃত্যুকূপে পাঠিয়েছি। এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হলে সমাজে এই ধরনের বাজে ঘটনা ঘটতেই থাকবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অন্য শিক্ষকরা এসব ঘৃণিত কাজ করতে ভয় পাবেন।
মো. ইমামুল খান বলেন, মুরাদ হোসেন এই ক্যাম্পাসে গণিতের জন্য বেস্ট টিচার। উনার সঙ্গে আগে কথা বলেছি অনেকবার। কিন্তু উনি এমন কাজ করবেন কখনো ভাবতেও পারি নাই। যখন শুনেছি এ ঘটনা তখন বেশ অবাকই হয়েছি। আসলে শিক্ষক ভালো হলেও চরিত্র যে ভালো থাকবে তা বলা কঠিন।
আরেফিন জান্নাত নামে এক অভিভাবক বলেন, যেদিন এ ঘটনার আলোচনা শুরু হয়েছে, সেদিনই উচিত ছিল উনাকে এখান থেকে সরিয়ে দেয়া। কিছু শিক্ষকের বিকৃত মানসিকতার কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। বাচ্চাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে গার্লস স্কুলে দিলাম। অথচ এখানেও অনিরাপদ মেয়েরা।
রোববার মানববন্ধনের দুই ঘণ্টা পর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী এসে শিক্ষার্থীদের বিচারের আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, আইনগতভাবে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত নেবো আমরা।
যৌন হয়রানির অভিযোগ ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হলেও তা নিয়ে অগ্রগতি ছিল না প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের পক্ষে। এরপর বিষয়টি আলোচনায় আসার পর নড়েচড়ে বসে প্রতিষ্ঠানটি। কোচিংয়ে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে শনিবার আজিমপুর শাখার গণিতের শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারকে সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। শাস্তি হিসেবে তাকে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তাকে মূল শাখায় সংযুক্ত করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত কমিটি করা হয়। ওই কমিটি ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত্ত না দেয়া পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত থাকবেন।
যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিচার চেয়ে গত ৭ই ফেব্রুয়ারি মুরাদ হোসেনের বিরুদ্ধে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার প্রধান সাবনাজ সোনিয়া কামালের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন কয়েকজন অভিভাবক। সেখানে তারা সন্তানদের সঙ্গে ঘটা যৌন হয়রানির বিবরণ দিয়ে অভিযুক্ত মুরাদ হোসেনের যথোপযুক্ত শাস্তি দাবি করেন। সেই অভিযোগপত্র যায় ভিকারুননিসার অধ্যক্ষের কাছে। পরদিন অধ্যক্ষ ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির আহ্বায়ক আইসিটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মমতাজ বেগম। সদস্য পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ফারহানা খানম ও ইংরেজি প্রভাতী শাখার শাখা প্রধান শামসুন আরা সুলতানা।
অভিযুক্ত শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারকে চাকরিচ্যুত না করলে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অভিভাবকরা। রোববার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এ হুঁশিয়ার উচ্চারণ করা হয়। এ সময় অভিভাবকরা বলেন, এই শিক্ষক আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়ন করে আসছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ভয়ে মুখ খুলতো না।
এই বিষয়ে মুরাদ হোসেন সরকার বলেন, এটা সরাসরি ষড়যন্ত্র। ৩ জন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছে তাদের ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালীন যৌন হয়রানি করা হয়েছে। এখন তারা নবম শ্রেণিতে। কাদের ইন্ধনে তারা এটা করছে। আমাকে জেলাসি করে এমন কিছু শিক্ষক তার সন্তান ও তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে একটা ফেসবুকে গ্রুপ খুলেছে যাতে আমি সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হই। একজন শিক্ষার্থী নির্যাতিত হয় তবে কি দুবছর পর অভিযোগ করবে? সহকর্মীদের দ্বারা আমি হ্যারেজমেন্টের শিকার হচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, কোনো পুরুষকে যদি ঘায়েল করতে হয় তবে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে দাও। সেটাই হয়েছে আমার ক্ষেত্রে। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।মানবজমিন