ডেস্ক রির্পোট:- বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ ১০ দফা নির্দেশনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই নির্দেশনার সবই পুরোনো। অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নেওয়ার সময়ই এসব শর্ত দেওয়া থাকে। কোন ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানে কী করা যাবে, কী করা যাবে না তা উল্লেখ করা থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোনো নির্দেশনা নতুন করে দিলেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। বরং গলদ দূর করতে হবে। নয়তো এর আড়ালে চাপা পড়ে থাকবে সব গলদ। কেন শর্ত মানা হচ্ছে না কিংবা মানানো যাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখে সেই অনুসারে পদক্ষেপ নিতে হবে। যখনই ঘটনা ঘটে তখনই বলা হয়, জনবলসংকটে মনিটরিং করা যায় না। বছরের পর বছর এমনটাই চলছে। জনবল বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না কেন, সেটাও খুঁজে দেখা দরকার।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘সবেমাত্র এক দিন হলো নির্দেশনা দিলাম। দুটো দিন যেতে দিন, রবিবার থেকে দেখতে পাবেন কী হয়! আমি নিজে মনিটরিং করব, মাঠে নামব।’
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক গত কয়েক দিনে দেশে স্বাস্থ্য খাতের অস্থিরতা প্রসঙ্গে বলেন, দেশের প্রাইভেট চিকিৎসাসেবা খাত এখন সরকারি চিকিৎসাসেবা খাতের চেয়ে অনেক বড় ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় সবাই ব্যস্ত সরকারি সেবা খাতে। বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মনিটরিং করার মতো সামর্থ্য নেই অধিদপ্তরের। সেই সঙ্গে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা ধরনের কারণে আইন-বিধি উপযুক্ত মাত্রায় কার্যকর হয় না। ফলে শুধু নির্দেশনা জারি করলেই লাভ হবে না। আবার কয়েক দিন পরই যেই, সেই।
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যবস্থাপনাগত সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না করলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। একটি হাসপাতাল বা ক্লিনিক হবে, সেখানে চিকিৎসার নামে মানুষ অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যাবে আর দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ তখন গিয়ে বলবে ওই সব প্রতিষ্ঠান অবৈধ বা আগের কোনো অনুমতি নেই, সেটা খুবই দুঃখজনক।
বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন গত বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন, এখন থেকে সরকারের নির্দিষ্ট শর্ত মেনে বেসরকারি মেডিকেল/ক্লিনিক/ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালাতে হবে। এর কারণ, কিছু অসাধু মানুষ নিয়মের তোয়াক্কা না করে শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থের জন্য যত্রতত্র নামমাত্র হাসপাতাল/ক্লিনিক/ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে এগুলো আর চলতে পারবে না। এখনো ১ হাজার ২০০টির ওপর প্রাইভেট স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিবন্ধন নেই। এদের কাছে ভালো ডাক্তার নেই, নার্স নেই, টেকনিশিয়ান নেই। এরা হাসপাতাল চালাচ্ছে কী দিয়ে?
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব বলেন, ১০ দফা নির্দেশনায় নতুন তো কিছু নেই। যেকোনো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদনের সময়ই এসব শর্ত দেওয়া থাকে। কিন্তু পরে সেটা আর মানা হয় কি না, তা দেখা হয় না বলেই এমন বিপত্তিতে পড়ে স্বাস্থ্য খাত। প্রাইভেট চিকিৎসা সেক্টর এখন ‘সোনার ডিম’। যার সুফল ভোগ করে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বেসরকারি উদ্যোক্তা চক্র। তারা যদি আইন মেনে কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা কার্যকর করে, তবে তো ওই ‘সোনার ডিম’ ভেঙে যাবে। তাদের পেছন দরজার আয় ইনকাম কমে যাবে। তাই তারাও চায় এই ব্যবস্থাটি দুর্বল থাকুক, শক্তিশালী না হোক।
প্রবীণ এই চিকিৎসক বলেন, ‘মুসলমানিতে কেন অজ্ঞান করা লাগে সেটা আমি বুঝি না। কেনইবা এভাবে দুটি শিশু মারা যাবে! এসব ডাক্তারকে দক্ষতা-যোগ্যতাও মনিটরিংয়ে রাখা দরকার।’ তিনি নিজের পেশার প্রতি সম্মান জানিয়েও বলেন, যেসব অবৈধ ও নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকরা কাজ করেন তাদেরও তো দায় আছে। তারা কি সেখানে চাকরি নেওয়ার সময় খোঁজখবর নেন না, নাকি নিজেও এমন প্রতিষ্ঠানই খুঁজে নেন!
১০ নির্দেশনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, এই নির্দেশনা তো নতুন কিছু না। আগেই বিভিন্ন সময়ে এমনটা দেখা গেছে। যখনই কোনো অঘটন ঘটে, তখনই এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে আর সেটি কার্যকর হয় কি না, তার খবর থাকে। এবার যেন এমনটা না হয়।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করতে হবে। সেখানে অভ্যন্তরীণ যেসব গলদ আছে তা দূর না করলে আইন, বিধি, নির্দেশনা- কিছুই কার্যকর করা যাবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ব্যবস্থাপনা শাখার জনবল মাত্র ১০ জন। যারা একদিকে সারা দেশের নানা ধরনের সমন্বয় কাজ করেন। নতুন নিবন্ধন দেওয়া, নবায়ন করা, যাচাই-বাছাই, পরিদর্শন, তদন্ত- সবকিছুই করেন। সেই সঙ্গে ঢাকা মহানগরীর সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনাও দেখভাল করার মূল দায়িত্ব তাদের। শুধু ঢাকায়ই বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, ‘আমাদের মাত্র ১০ জনের পক্ষে এত প্রতিষ্ঠান দেখভাল করা কঠিন। অনুমোদন করা পদই আছে ১০টি। এখন আমি অস্থায়ীভাবে হলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও কয়েকজনকে চাইব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে।’
১০ নির্দেশনায় যা আছে
বেসরকারি ক্লিনিক/হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্সের কপি ওই প্রতিষ্ঠানের মূল প্রবেশ পথের সামনে দৃশ্যমান স্থানে অবশ্যই স্থায়ীভাবে প্রদর্শন করতে হবে, সব বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্যাদি সংরক্ষণ ও সরবরাহের জন্য একজন নির্ধারিত দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা/কর্মচারী থাকতে হবে এবং তার ছবি ও মোবাইল নম্বর দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতাল হিসেবে আছে কিন্তু শুধু ডায়াগনষ্টিক অথবা হাসপাতালের লাইসেন্স রয়েছে তারা লাইসেন্স ছাড়া কোনোভাবেই অন্য সেবা দিতে পারবে না। ডায়াগনষ্টিক সেন্টার/প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির ক্ষেত্রে যে ক্যাটাগরিতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত শুধু সে ক্যাটাগররিতে নির্ধারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কোনোভাবেই অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে না এবং ক্যাটাগরি অনুযায়ী প্যাথলজি/মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও রেডিওলজি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করতে হবে। বেসরকারি ক্লিনিক/হাসপাতালের ক্ষেত্রে লাইসেন্সের প্রকারভেদ ও শয্যা সংখ্যা অনুযায়ী সব শর্তাবলি বাধ্যতামূলকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে; হাসপাতাল/ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়োজিত সব চিকিৎসকের পেশাগত ডিগ্রির সনদ, বিএমডিসির হালনাগাদ নিবন্ধন ও নিয়োগপত্রের কপি অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। হাসপাতাল/ক্লিনিকের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অপারেশন/সার্জারি/প্রসিডিউরের জন্য অবশ্যই রেজিস্টার্ড চিকিৎসককে সার্জনের সহকারী হিসেবে রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই লাইসেন্স প্রাপ্ত/নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ব্যতীত চেম্বারে অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যাবে না। বিএমডিসি স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ অবেদনবিদ ছাড়া যেকোনো ধরনের অপারেশন/সার্জারি/ প্রসিডিউর করা যাবে না। সব বেসরকারি নিবন্ধিত হাসপাতাল/ক্লিনিকে প্রসব কক্ষ প্রটোকল অবশ্যই মেনে চলতে হবে। নিবন্ধিতপ্রাপ্ত হাসপাতাল/ক্লিনিকে অপারেশন থিয়েটারে অবশ্যই নির্ধারিত শর্ত মেনে চলতে হবে।খবরের কাগজ