খাগড়াছড়ি:- খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার অদূরে তপ্ত মাস্টারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২০২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে এখানে। যার মধ্যে ১৯৫ জনই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর। চাকমা সম্প্রদায়ের ২৩ জন শিক্ষার্থী থাকলেও ওই সম্প্রদায়ের কোনো শিক্ষকই নেই বিদ্যালয়ে। ১৭১ জন ত্রিপুরা এবং একজন মারমা শিক্ষার্থী বরাবরের মতো প্রতি বছরের শুরুতেই হাতে পেয়েছে স্ব স্ব মাতৃভাষার বই। তবে সেসব বই কখনো পড়ার সৌভাগ্য হয়নি তাদের। অর্থাৎ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষার পাঠদান হয় না এই বিদ্যালয়ে।
রবিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীই মাতৃভাষার কোনো বই নিয়ে আসেনি। কারণ জানতে চাইলে তারা জানায়, বই পেয়েছে ঠিকই তবে মাতৃভাষায় পাঠদান করানো হয় না তাদের। আর তাই বিদ্যালয়ে আসার পথে বইয়ের বোঝা বাড়ায় না তারা।
তপ্ত মাস্টারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ রয়েছেন মোট সাতজন শিক্ষক। তার মধ্যে তিনজন ত্রিপুরা এবং একজন রয়েছেন মারমা সম্প্রদায়ের। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কেউই মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ পাননি। সহকারী শিক্ষক চন্দ্রমণি ত্রিপুরা, ললিতা বালা ত্রিপুরা এবং আওঅং মারমা জানান, নিজেরাই চেনেন না স্ব স্ব মাতৃভাষার বর্ণমালা। প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় শিক্ষকরাই পারেন না মাতৃভাষায় পড়তে কিংবা লিখতে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নূরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশিক্ষণ না পাওয়ার ফলে শিক্ষকরা মাতৃভাষায় পাঠ দিতে পারছেন না। ফলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে মায়ের ভাষার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে।’
জেলার হাতেগোনা কয়েকটি বিদ্যালয় ছাড়া বাকি বিদ্যালয়গুলোর চিত্রও একই রকম। ২০১৭ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে সরকার। প্রতিবছরই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয় মাতৃভাষার বই। খাগড়াছড়িতে এ বছর প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ত্রিপুরা, চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের ৩৮ হাজার ২৯১ জন শিক্ষার্থীর মাঝে বছরের শুরুতেই মাতৃভাষার পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়েছে মোট ১ লাখ ৫ হাজার ১১২টি। তবে সেসব বই পড়ে আছে শিক্ষার্থীদের ঘরের তাকে, অযত্নে বইগুলোতে জমছে ধুলো।
বেশির ভাগ বিদ্যালয়েই চলছে না মাতৃভাষার পাঠদান। খাগড়াছড়িতে ৫৯৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক রয়েছেন ২ হাজার ৯৩ জন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে বেসরকারিভাবে কেবলমাত্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তিন সম্প্রদায়ের ২৫ জন করে অর্থাৎ চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মোট ৭৫ জন শিক্ষককে মাতৃভাষায় পাঠদানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। বাকি ২ হাজার ১৮ জন শিক্ষকের কেউই এ বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাননি এখনো। ফলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষার শিক্ষা বিস্তারে সাত বছর আগে নেওয়া সরকারি উদ্যোগ এখনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। উপরন্তু প্রতিবছর সরকারিভাবে দেওয়া কোটি টাকার বই কোনো কাজেই লাগছে না শিক্ষার্থীদের।
এদিকে মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল করতে দ্রুত কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। খাগড়াছড়ির সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত। তাই খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণ চালুর ব্যাপারে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও সরকারিভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।’
অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা গবেষকরা বলছেন, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী অনুপাতে স্ব-ভাষার শিক্ষক পদায়ন এবং সরকারিভাবে শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি পাঠ্যবইকে আরও বেশি সহজ এবং শিশুবান্ধব করতে হবে। নইলে সরকারি এই উদ্যোগ এভাবেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে বছরের পর বছর।
কবি ও মারমা ভাষা গবেষক চিংহ্লামং চৌধুরী বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের ঝরে পড়ার হার কমাতে এবং মনন বিকাশের জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তবে কিছু ঘাটতিও রয়ে গেছে। মারমা ভাষার বইয়ে যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো আরও কীভাবে সহজ করা যায় সেদিকে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।’
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ও ভাষা গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরা বলেন, ‘নিজের মায়ের ভাষায় পড়ার সুযোগ পাওয়া খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। তবে সাত বছরেও এই কার্যক্রম ততটা সফল হয়নি। কিছু স্কুলে শিক্ষকসংকট, আবার কোথাও শিক্ষক থাকলেও তাদের মাতৃভাষায় পাঠদানের দক্ষতা নেই। সুতরাং শিক্ষার্থীদের অনুপাতে স্ব স্ব সম্প্রদায়ের শিক্ষক পদায়ন এবং সেসব শিক্ষকদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দক্ষ করে তোলার বিকল্প নেই।’
খাগড়াছড়ি ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের অপর দুই জেলা বান্দরবান এবং রাঙ্গামাটিতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ হাজার ৬১৯টি। আর এসব বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৪২ হাজার ৪৯৫ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষকদের মাতৃভাষার ওপর দক্ষতা না থাকায় বঞ্চিত হচ্ছে সেসব শিক্ষার্থীরাও। খবরের কাগজ