ডেস্ক রির্পোট:- পার্বত্য চট্টগ্রামে বন উজাড় ও ধ্বংসের বিপরীতে ভিন্ন এক সাফল্যগাথার নাম পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও পাবলাখালী গেইম সেঞ্চুয়ারি রেঞ্জ। অসংখ্য সুউচ্চ বৃক্ষ, লতা গুল্ম ও প্রাকৃতিক ঝোপের কারণে বনটি চিরহরিৎ রূপ পেয়েছে। বন্যপ্রাণীর নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্রও হয়ে উঠেছে প্রায় ২শ বছরের পুরনো এই বন। বন রক্ষা পাওয়ায় পুরো জনপদের জন্য তা আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতাধীন পাবলাখালী রেঞ্জ ও স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ এই বন রক্ষায় কাজ করছে। বনজুড়ে চিরহরিৎ বা চির সবুজ উদ্ভিদের প্রাধান্য। সম্প্রতি পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও পাবলাখালী গেইম সেঞ্চুয়ারি রেঞ্জ ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা যায়। শীতের শুষ্ক মৌসুমেও পুরো বন সবুজ হয়ে উঠেছে। দৃষ্টিসীমায় নানা প্রজাতির চিরহরিৎ বৃক্ষের সমাহার। বন টিকে থাকার পেছনে বন বিভাগের পাশাপাশি বড় ভূমিকা পালন করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাঙামাটি জেলার লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলাজুড়ে এর বিস্তৃিত। এর আয়তন ৪২০৮৭.০ হেক্টর।
বন বিভাগের নিয়মিত নজরদারি, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বন রক্ষার গুরুত্ব উপলদ্ধি বৃদ্ধি পাওয়া, বনের ভেতরে বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাসহ একাধিক উদ্যোগ নেওয়ার কারণে পাবলাখালী অভয়ারণ্য চিরহরিৎ রূপ পেয়েছে।
বনের ভেতরে কথা হয় সারোয়াতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা সূর্যলাল চাকমার সঙ্গে। বয়স ৫০ ছুঁইছুঁই। তিনি বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে বনটি দেখে আসছি। ছোটবেলায় বনে যে বৃক্ষগুলো দেখেছি সেগুলো এখনো রয়েছে। দিনে দিনে গাছগুলো উঁচু হয়েছে। এখানে অসংখ্য বড় বড় গাছ রয়েছে। কোনো বহিরাগত গাছ কাটার জন্য প্রবেশ করতে পারে না। স্থানীয়রাও রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে কখনো গাছ কাটে না। বন না থাকলে ঝিরিতে পানিও থাকবে না–এটি এখানকার মানুষ বিশ্বাস করে। ফলে কেউ গাছ কাটে না এবং অন্যদেরও কাটতে দেয় না। বন বাঁচলে তো আমরা বাঁচব। একই গ্রামের বাসিন্দা তারুম চাকমা বলেন, বনের ভেতরে বড় বড় গাছপালা রয়েছে। কিন্ত কেউ গাছ কাটে না। বাইরের কোনো মানুষ বনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। বন থাকার কারণে ছড়া ও ঝিরিতে সারা বছরই পানি থাকে। ঝিরির পানিতে আমরা জমি চাষ করি। বনে গাছপালা না থাকলে ঝিরি শুকিয়ে যেত বলে জানান তিনি।
পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও পাবলাখালী গেইম সেঞ্চুয়ারি রেঞ্জে সেগুন, গর্জন, গামারি, সিভিট, লম্বু, তেলসুর, চাপালিশ, জলপাই, উড়ি আম, খুদে জাম, হরতকি, বহেরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ দেখা গেছে।
পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন রিকো চাকমা, অভিজিৎ চাকমা, জহরুল লাল রুদ্রসহ ৬ জন বনকর্মী। তারা জানান, আমরা নিয়মিত বন রক্ষায় কাজ করি। শিফটভিত্তিক ভেতরে টহল দিই। বন রক্ষায় স্থানীয় মানুষেরাও আমাদের সহযোগিতা করে। বনে টহল দেওয়ার সময় তাদের সাথে করে নিয়ে যাই। বনের শতবর্ষী বৃক্ষ যাতে কেউ কাটতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকি।
পাবলাখালী রেঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সজীব মজুমদার বলেন, গেইম সেঞ্চুয়ারি বলতে বোঝায় একটি নির্দিষ্ট বন এলাকা, যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ অধিকার সংরক্ষিত। সকল বন্যপ্রাণী নিরাপদে বেড়ে উঠবে এবং বন্যপ্রাণীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যাবে। মূলত বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল। পাবলাখালীতে আমরা সেটা করতে পেরেছি। বনকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সহায়তায় পাবলাখালী অভয়ারণ্য সমৃদ্ধ হয়েছে। এছাড়া বনে মাতৃবৃক্ষ টিকে থাকায় এটি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। মায়া হরিণ, ভালুক, অজগরসহ নানা প্রজাতির সাপ, বন মোরগ, শূকর, ময়না, টিয়াসহ নানা প্রজাতির পাখি দেখা যায়। তবে বন রক্ষায় জনবল অপ্রতুল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অজিত কুমার রুদ্র বলেন, পাবলাখালী গেইম সেঞ্চুয়ারি রেঞ্জ ও পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য পুরোটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এটি রক্ষায় একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বনের ফাঁকা অংশে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। ২০২০–২১ অর্থবছরে প্রাকৃতিক পুনর্জন্ম সহায়তাকরণ প্রকল্পের আওতায় ২০ হেক্টর জমিতে দশ হাজার গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। এছাড়া বন রক্ষায় ২০ বছর মেয়াদী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, যা খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে বন আরো নিরাপদ হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, বন রক্ষায় আমরা স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে কনভিন্স করতে পেরেছি। তারা বন বিভাগকে সহায়তা করছে। কেউ গাছ কাটে না। ফলে বনটি অক্ষত রয়েছে।