ঢাকা: কিছু দিন আগেই ঘরে উঠেছে কৃষকের আমন ধান। এবার মাঠে মাঠে লাগানো হচ্ছে বোরো। আমনের রেকর্ড বাম্পার উৎপাদনে গোলা ভরেছে কৃষকের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) প্রাথমিক হিসাবে এই তথ্যে অনুসারে এবার এক কোটি ৬৯ লাখ টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে আমনে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ছয় লাখ টন বেশি। আমনের ফলন ভালো হওয়া কৃষক এখন মনোযোগ দিয়েছে বোরোতে। তবে আমনের রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদনের পরও চালের দাম তেমন কমেনি। চাল নিয়ে নানামুখি আলোচনা রয়েই গেছে। সামনে আসছে রোজা, চালের দাম সাধ্যের মধ্যে থাকবে সে প্রত্যাশা ক্রেতাদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দেশে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও উৎপাদন হয়েছে ৫৯ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে। কৃষি মন্ত্রণায়ের আপ্রাণ চেষ্টার কারণে শেষ পর্যন্ত আমন আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এক কোটি ৬৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬০০ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এবারের আমন মৌসুমে ছিল নানা উৎকণ্ঠা। কেননা, উৎপাদন মৌসুমে শঙ্কা ছিল ঘূর্ণিঝড়। ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে কৃষক ছিল নানা দুশ্চিন্তায়। গত বছর ধানের ভালো দাম পাওয়ার কারণে কৃষকের আমন ধান চাষে আগ্রহ বেশি ছিল। ফলে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় কাছাকাছি জমিতে আমনের আবাদও হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সব মিলে আমাদের উৎপাদন ভালো হয়েছে এটিই মূখ্য বিষয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৫৭ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন মৌসুমে চালের উৎপাদন ছিল এক কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার টন। ফলে ডিএইর প্রাথমিক উৎপাদনের তথ্য চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হলে উৎপাদন বাড়বে ১৯ লাখ ৭২ হাজার টন।
এর আগে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর এবার ভালো ফলন হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
আমন ধানের বাম্পার ফলন নিয়ে তিনি বলেন, আবহাওয়া একটি বড় কারণ। আর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় অনেক নিচু জমি আমন চাষের আওতায় এসেছে। আমনের বাড়তি ফলনের কারণে দেশে আগামী জুন পর্যন্ত চালের কোনো সংকট হবে না বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বলছে, চলতি মৌসুমে আমনের ফলন হয়েছে হেক্টর প্রতি ২.৭৬ টন যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৭ শতাংশ বেশি। হেক্টরপ্রতি আমনের এই ফলন ছিল ২০১৭ সালে ২.৪৫ টন, ২০১৮ সালে ২.৪৬, ২০১৯ সালে ২.৫০, ২০২০ সালে ২.৫৫ এবং ২০২১ সালে ২.৫৭ টন।
ব্রির হিসাবে, এ বছর (২০২২ সালে) আমনে প্রায় ১ কোটি ৬৩ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে।
এ বছর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে ৩১ জেলার ৮০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর আমন মৌসুমের ধান আবাদি জমি আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। তারমধ্যেও এবার আমনের আশাতীত ফলনের কারণ হচ্ছে অনুকূল আবহাওয়া। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমনের ভালো ফলনের জন্য পরিস্কার সূর্যালোক, অধিক সৌর বিকিরণ, অধিক গড় তাপমাত্রা, কম আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং মেঘমুক্ত আকাশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বাজারে চালের দামে বড় কোনো পরিবর্তন নেই। উচ্চমূল্য স্থিতিশীল হয়ে আছে সব ধরনের চালে। মোটা চালের দাম মাঝে পাইকারিতে কেজিপ্রতি দু-এক টাকা কমলেও আবার একটু বেড়েছে। কারওয়ান বাজারে গত দুইদিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি আটাশ চাল ৫৬ টাকা (নতুন) ও ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট চালের দাম ৭২ থেকে ৭৬ টাকা ও নাজিরশাইল চালের দাম ৭৬ থেকে ৮৪ টাকা।
কারওয়ান বাজারে বিক্রেতা সোরহান উদ্দিন বলেন, গত ডিসেম্বর মাস পুরোটাই ছিল বেশি দাম। জানুয়ারি মধ্যেই কিছু কমলেও খুব কমেছে বলা যাবে না। মোটা চালের বাজার একটু কমেছে। বাজারে এসে সবাই জানতে চায় উৎপাদন ভালো দাম বেশি কেন? এটির উত্তর আমরাও জানি না।
গত শনিবার, রোববার রাজধানীর শান্তিনগর, মালিবাগ, হাতিরপুল বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজার উঠানামার মধ্যেই আছে।
হাতিরপুলের এক ব্যবসায়ী বলেন, মোটা চালের কেজি ৫০ টাকার ওপরেই বিক্রি হচ্ছে। কোথাও এক দুটাকা কম পেতে পারেন। অনেক বাজারে মাঝারি মানের বিআর ২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি ৬০ টাকার ওপরে। নাজিরশাইল চালের দাম পড়ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায়। কারণ হিসেবে ওই ব্যবসায়ী বলেন, খরচও আছে নানা ধরনের বাজারভেদে।
মালিবাগ বাজারে ক্রেতা হালিম উদ্দিন বলেন, আমি আমার মহল্লার বাজারে চাল কিনেছি ৫১ টাকা কেজি। বাজারে ৪৯ করে কিনেছি। আবার মহল্লায় অনেক সময় কম দেখা যায় বাজারে বেশি। তবে যে পরিমাণ উৎপাদন তাতে আরও কমা উচিত। সামনে রোজা আসতেছে কি হবে বুঝতেছি না।
বাজার করতে আসা মুহিবুল বলেন, চাল ডাল, তেল বলেন সবইতো যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ার মতো বিষয়। এই যে চিনি কেউ প্যাকেট বিক্রি করে না। জিজ্ঞেস করলে বলে- নাই খোলাটা আছে। খোলাটায় বিক্রি হচ্ছে দামের চেয়ে অনেক বেশি কি করবেন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক আমনের ফলন নিয়ে বলেছেন, মৌসুমের শুরুতেই কৃষকের প্রচণ্ড আগ্রহের কারণে আবাদে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে। তা ছাড়া অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এবারে আমনে চিটা কম হয়েছে, যার কারণে হেক্টরপ্রতি ফলন ভালো পেয়েছেন দেশের কৃষক। তেমনি প্রকৃতি বেশ সহায়ক ছিল। ধানের মৌসুমে প্রায় সাত লাখ সেচযন্ত্র সচল রাখা হয়েছিল। উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত ও কৃষি উপকরণ আমরা কৃষকের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। তারা ধানের দামও ভালো পেয়েছে।
কৃষিমন্ত্রীর মতে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় আমনের বাম্পার ফলন সামনের বোরো মৌসুমে কৃষকদের উৎসাহিত করবে।
ক্রেতা বিক্রেতা উভয় পণ্যের দাম নিয়ে নানমুখি আলোচনা করলেও বিক্রতারা কমানোর পক্ষে আর ক্রেতাদের যুক্তি তাদের উপায় নেই, সামান্য লাভ করছেন তারা। তবে বাজার মনিটরিংয়ে আরও গুরুত্বের কথা বলেছেন অনেকেই।