ডেস্ক রির্পোট:- দেশের সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখনও নেই একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট। অথচ উন্নত বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবার মূল ভিত্তিই গড়ে উঠেছে ডাক্তার-নার্স-ফার্মাসিস্টের সমন্বয়ে। বাংলাদেশে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য টেকনোলজিস্ট থাকলেও সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সংক্রান্ত সেবা দেন না কোনো গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট। ফলে রোগীরা যেমন ওষুধ ব্যবহারে বিভ্রান্ত, তেমনি বাড়ছে এর অপব্যবহার, বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক।
এ বাস্তবতায় আজ ২৫ সেপ্টেম্বর পালন করা হচ্ছে বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য– ‘স্বাস্থ্যসেবায় ফার্মাসিস্টদের ভাবনা’। দিনটির মূল লক্ষ্য, আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব তুলে ধরা ও পেশাজীবীদের মধ্যে সংহতি জোরদার করা।
ভুল ব্যবস্থাপত্রের ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় যেখানে অনেক ওষুধের সমন্বয় প্রয়োজন, সেখানে প্রতিটি ওষুধের ডোজ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মিথস্ক্রিয়া মূল্যায়ন করা ফার্মাসিস্টদের কাজ। অথচ বাংলাদেশে এ কাজও চিকিৎসকদের করতে হচ্ছে। ফলে তাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। ওষুধের ব্যবস্থাপত্রে ভুল বা দ্বন্দ্বও বাড়ছে।
বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. আসিফ হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে সরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থায় এখনও একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এতে রোগীরা মৌলিক ফার্মেসি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’ তিনি জানান, সরকারি হাসপাতালে কিছু ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট থাকলেও তারা মূলত চিকিৎসকদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেন। রোগীর জন্য ওষুধের ডোজ সমন্বয়, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিরীক্ষা, ওষুধ সংরক্ষণ– এসব বিষয়ে পূর্ণ দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা রাখেন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরাই।
বাস্তবায়ন হয়নি ২০১৯ সালের প্রজ্ঞাপন
২০১৯ সালে সরকার এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের ফার্মেসিতে একজন ও অন্তঃবিভাগে প্রতি ৫০ শয্যার বিপরীতে একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়ন হয়নি সেই নির্দেশনা। বর্তমানে দেশে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট রয়েছেন ১৮ হাজার ৯২১ জন। কিন্তু তাদের ৯০-৯৫ শতাংশ চাকরি করছেন ওষুধ কোম্পানিতে। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তাদের স্থান না থাকায় তারা রোগীর সেবায় যুক্ত হতে পারছেন না।
মুদির দোকানে ওষুধ বিক্রি
বাংলাদেশে প্রতিদিন ২০ লাখ মানুষ ওষুধ কিনে থাকেন ফার্মেসি থেকে। অথচ এর বেশির ভাগই চালান তিন মাসের একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নেওয়া বিক্রেতা। কোথাও কোথাও শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা ব্যক্তিরাও ওষুধ বিক্রি করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, ১০ হাজার মানুষের জন্য থাকা উচিত ২ দশমিক ৫টি ফার্মেসি। বাংলাদেশে এ সংখ্যা ১৯-এরও বেশি।
‘ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস ফর হেলথ’-এর একটি প্রকল্পে ফার্মেসি টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও ফান্ড সংকটে তা বন্ধ হয়ে গেছে। এ প্রকল্পের কারিগরি উপদেষ্টা রায়ান আমজাদ বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে শুধু রোগীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, কার্যকারিতা হারাবে অনেক ওষুধও।’
নিয়ন্ত্রণ ও তদারকের অভাব
দেশে বর্তমানে এক লাখ ৪৮ হাজার ২০২ জন ফার্মেসি টেকনিশিয়ান থাকলেও ঔষধ প্রশাসনের পরিদর্শক সংখ্যা হাতেগোনা। প্রতিটি ফার্মেসিতে নিয়মিত পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা হয় না। এতে সংরক্ষণ না মেনে ওষুধ বিক্রি, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখা ও অপব্যবহার রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
নতুন উদ্যোগ, তবে প্রশ্ন রয়ে যায়
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘আমরা ৭০০ সরকারি হাসপাতালে ফার্মেসি নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনা করছি। ফার্মাসিস্ট ছাড়া নিরাপদ ওষুধ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘মুদি দোকান আর ফার্মেসি এক নয়। ওষুধ দেওয়া একটি বিশেষায়িত কাজ। আমরা এ খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছি।’ এ ছাড়া চিকিৎসকদের ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে উপহার নেওয়া বন্ধে আইনি ব্যবস্থার কথাও জানান তিনি।