পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা ও প্রশাসনের ভূমিকা: নিরাপত্তা না শাসন?

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
  • ৬৩ দেখা হয়েছে

সনজিত চৌধুরী:- পার্বত্য চট্টগ্রাম-প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার সম্ভার, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীর আবাসস্থল। এই অঞ্চলের জটিল ইতিহাস, রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

একসময় দাঙ্গা-সংঘাতে জর্জরিত এই জনপদ এখন স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে চলেছে। আর এই অগ্রযাত্রার পেছনে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের বেসামরিক প্রশাসনের রয়েছে নিরলস ও সমন্বিত প্রয়াস।

অনেকেই প্রশ্ন করেন—পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের ভূমিকা আসলে কী? নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, না শাসন করা? বাস্তবতা হলো, সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি খুবই পরিষ্কার-এলাকায় শান্তি, স্থিতি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা। তারা ‘নিরাপত্তার ছায়াতলে উন্নয়ন’ কৌশল মেনে পাহাড়ে কাজ করছে, যেখানে শান্তি ও স্থিতি ছাড়া কাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সেনাবাহিনীর কিছু নিরাপত্তা ক্যাম্প রয়েছে। এসব স্থাপনা শুধু পাহাড়ে সন্ত্রাস দমনেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং দুর্গম এলাকার মানুষের চিকিৎসা, শিক্ষাসেবা, জরুরি সহায়তা, দুর্যোগকালীন ত্রাণ বিতরণ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে সেনাবাহিনী এক অনন্য ভূমিকা রাখছে।

বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, স্কুল প্রতিষ্ঠা, রাস্তা নির্মাণ, সেতু স্থাপন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড আজ পাহাড়ি জনগণের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। একইভাবে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীও স্থানীয় বাঙালি ও উপজাতি জনগণের সঙ্গে সম্প্রীতির বন্ধন রচনা করে প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, আজও পাহাড়ে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু উপজাতি সশস্ত্র গোষ্ঠী। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের এত বছর পরও এদের একাংশ এখনো চুক্তির বিরোধিতা করে অস্ত্র হাতে পাহাড় দখলের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যার বড় অংশ—উপজাতি ও বাঙালি উভয়ই—এই বাহিনীগুলোর হাতে আজ জিম্মি। চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, গুম, দখল, ভয়ভীতি প্রদর্শন—এসব যেন তাদের নিত্যদিনের কাজ।

বিশেষ করে, বাজারে ব্যবসা করতে হলে চাঁদা দিতে হয়, স্কুল তৈরি করতে হলেও চাঁদা দিতে হয়, এমনকি সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও বাধা সৃষ্টি করে এসব উপজাতি সশস্ত্র গোষ্ঠী। উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদাররা বহু ক্ষেত্রে প্রাণভয়ে কাজ ছেড়ে দেন।

পাহাড়ে হাসপাতাল, রাস্তা বা স্কুল নির্মাণের কাজ মাঝপথে থেমে যেতে দেখা যায় শুধু তাদের বাধার কারণে। এভাবে যারা নিজের জনগণের উন্নয়নের বিরোধিতা করে, তারা আসলে কার স্বার্থ রক্ষা করছে, সেটি আজ বড় প্রশ্ন।

আরো দুর্ভাগ্যজনক হলো, এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ভয়ে বহু উপজাতি পরিবার নিজের এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। অনেকে গোপনে সেনাক্যাম্পে এসে আশ্রয় চাইছেন, যেটা থেকে পরিষ্কার—এই অস্ত্রধারীরা উপজাতিদের প্রতিনিধি নয়, বরং তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বাঙালিরা যেমন তাদের দ্বারা নির্যাতিত, তেমনি ভুক্তভোগী উপজাতিরাও।

এই বাস্তবতায়, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের ভূমিকা কোনোভাবেই ‘শাসন’ নয়, বরং এটি জনগণের ‘নিরাপত্তা ও সেবাদান’ নিশ্চিত করার একটি প্রক্রিয়া। যদি সেনাবাহিনী না থাকত, তবে পাহাড়ে শান্তিচুক্তি রক্ষার বাস্তব কাঠামো থাকত না। যদি প্রশাসন সক্রিয় না থাকত, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা অবকাঠামো উন্নয়নের কোনো কার্যক্রমই পরিচালিত করা যেত না।

পাহাড়ি জনগণের একাংশ এ অভিযোগ করেন যে, সেনাবাহিনীর উপস্থিতি তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। বাস্তবে এটি ভুল ব্যাখ্যা। আসলে, সরকার ও সেনাবাহিনী অত্যন্ত সংবেদনশীলতা ও সহনশীলতার সঙ্গে পাহাড়ি সংস্কৃতি ও অধিকারকে সম্মান জানিয়ে নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মানবাধিকার রক্ষা ও শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

অন্যদিকে, অস্ত্রধারী সংগঠনগুলো প্রকৃত অর্থে পাহাড়ের উন্নয়ন চায় না, তারা চায় বিচ্ছিন্নতাবাদ, তারা চায় জনসাধারণকে ভয় দেখিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে। এসব গোষ্ঠী শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের শত্রু। তাদের প্রতিহত করা শুধু সরকারের একার দায়িত্ব নয়, বরং স্থানীয় জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।

সরকার ইতোমধ্যে উপজাতি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পাহাড়ি জনপদে শান্তি আনতে হলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐক্য অপরিহার্য। সেই সঙ্গে উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নাগরিক সুরক্ষার মাধ্যমেই স্থায়ী শান্তি সম্ভব।

অতএব, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন পাহাড়ে যে ভূমিকা পালন করছে, তা নিছক শাসনের নয়—এটি পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের কল্যাণের জন্য একটি দায়িত্বশীল অবস্থান। আর যে কেউ যদি এই কল্যাণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়—সে যত বড় সংগঠনই হোক না কেন, তাকে প্রতিহত করাই হবে জনগণের পক্ষ নেওয়া।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions