অপরাধী হাসিনাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপে ভারত

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ৪৭ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- জুলাই গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারতের ওপর নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে এই চাপ আরো বাড়বে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এবং আইনজ্ঞরা মনে করছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, হাসিনার বিচার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে যুক্ত করা গেলে নিশ্চিতভাবেই ভারত চাপে পড়বে। জাতিসংঘের রিপোর্টে ভারতের আশ্রয়ে থাকা হাসিনাকে জুলাই হত্যাকাণ্ডের প্রধান খুনি হিসেবে চিহ্নিত করার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, আমরা শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের ফিরিয়ে এনে গণহত্যার দায়ে বিচার করব। অর্থাৎ ভারতকে এখন বিচারের জন্য হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে হবে।

বিচারের জন্য হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এতদিন এক রকম নীরব ছিল। জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠান, গণহত্যার দায়ে তার বিচার হতে হবে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও জুলাই গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা যেন কোনোভাবেই দায়মুক্তি না পায়।

উল্লেখ্য, জুলাই বিপ্লবে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জাতিসংঘ গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট গত ১২ ফেব্রুয়ারি জেনেভায় জাতিসংঘ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টে জুলাই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে ভারতের আশ্রয়ে থাকা বিতাড়িত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করে বলা হয়েছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা, নির্দেশনা এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে জুলাই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। তিনিই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের বিক্ষোভ দমনে হত্যার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, বিক্ষোভকারী ছাত্রদের গুলি করে হত্যার পর তাদের লাশগুলো গুম করে ফেলো।

জুলাই বিপ্লবে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের রিপোর্টে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, কমপক্ষে এক হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৩ ভাগ শিশু। আহতের সংখ্যা হাজার হাজার।

জাতিসংঘের এ রিপোর্ট প্রকাশের পর বাংলাদেশের ভেতরে এবং বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনাসহ জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচার এবং হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত পাঠানোর দাবি জোরদার হচ্ছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক জুলাই গণহত্যার তদন্তের জন্য গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে জুলাই বিক্ষোভ দমনে যে ধরনের হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কেউ যেন দায়মুক্তি না পায়।

মানবাধিকার কমিশনার জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, প্রকাশিত রিপোর্টের বাইরে আরো অনেক তথ্য রয়েছে। আমরা এসব তথ্য দিয়ে বিচারকাজে সহায়তা দিতে চাই। এ বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। ভবিষ্যতে যেন আর কখনো এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার জন্য জড়িতদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

জাতিসংঘ রিপোর্ট প্রকাশের পর হাসিনার বিচারের জন্য তাকে ফিরিয়ে আনতে ভারতের ওপর নতুন করে চাপ তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার হচ্ছে। পাশাপাশি বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ইতোমধ্যেই কথা বলেছেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য ন্যাশনালকে এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, আমরা শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের ফিরিয়ে এনে বিচার করব। এই বিচার অবশ্যই হবে। বিচারের হাত থেকে কেউ রেহাই পাবে না। আমরা যদি এই বিচার না করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের জনগণ আমাদের ক্ষমা করবে না। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার বিচারের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। জুলাই গণহত্যার প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে। শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীরা কী করেছেন, তার সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জাতিসংঘ তার প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করেছে। তাই কেউ রেহাই পাবে না।

জুলাই গণহত্যার মূলহোতা শেখ হাসিনা ভারতের আশ্রয়ে থাকার প্রসঙ্গ তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্ট শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের চালানো গণহত্যার অকাট্য দলিল। আমরা ইতোমধ্যে ভারতকে নোটিস দিয়েছি, দ্রুত শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠান। গণহত্যার দায়ে আমরা তার বিচার করব।

জুলাই গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের রিপোর্টের পর বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর জন্য ভারতের কাছে জোরালো দাবি জানানো হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জুলাই গণহত্যাসহ বিগত ১৫ বছরের যাবতীয় হত্যা নির্যাতনের সব কাহিনি প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। আমরা জাতিসংঘকে তাদের রিপোর্টের জন্য ধন্যবাদ জানাই। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নির্দেশেই যে জুলাই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে জাতিসংঘ রিপোর্টের মাধ্যমে তা প্রমাণিত।

হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা ভারত সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, তাকে অবিলম্বে বাংলাদেশে ফেরত পাঠান। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনার বিচার করবে।

জাতিসংঘ রিপোর্টের পর শেখ হাসিনার বিচার এবং তাকে ভারত থেকে ফেরত আনতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো যখন একইভাবে সোচ্চার হচ্ছে, তখন ভারতের ওপর নতুনভাবে চাপ তৈরি হবে বলে মনে করছেন কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

এ প্রসঙ্গে আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে সাবেক একজন পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ভারত জানত শেখ হাসিনা জুলাই বিক্ষোভ দমনে ঠিক কী করেছে। কোনো ঘটনাই ভারতের অজানা নয়। জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ভারত কিছুটা হলেও নতুনভাবে চাপে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, ভারতের ওপর চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে ফেরাতে বাংলাদেশের সামনে আসলেই একটাই পথ খোলা, বিষয়টি নিয়ে সরাসরি জাতিসংঘে যাওয়া।

জাতিসংঘে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের কার্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়া। শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে তার বিচারের জন্য যদি জাতিসংঘের মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে ভারত কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না এবং একই সঙ্গে শেখ হাসিনা ইস্যুতে ভারত চাপে পড়বে।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে জুলাই গণহত্যা এবং শেখ হাসিনার বিচারের ইস্যুটি তুলে ধরার পরামর্শ দিয়ে বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বলেন, শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার বিষয়টি বারবার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরতে হবে। ভারতের পরিকল্পনা এবং সহযোগিতার মাধ্যমেই যে জুলাই গণহত্যা হয়েছে, সেই রিপোর্ট আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে হবে। শেখ হাসিনা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন খুনি। আর এই খুনিকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত।

জুলাই বিপ্লব নিয়ে ভারতের অবস্থানের কড়া সমালোচনা করে অধ্যাপক শহীদুজ্জামান বলেন, বর্তমান ভারত সরকারের কোনো লজ্জা নেই। আপনারা সবাই দেখেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে অবৈধ ভারতীয়দের ধরে ধরে হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দাগি সন্ত্রাসীদের মতো প্লেনে তুলে দিয়েছে। কতটা নির্লজ্জ হলে সেই ট্রাম্পের কাছে নরেন্দ্র মোদি জুলাই বিপ্লব এবং বাংলাদেশের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নালিশ জানাতে পারে।

ভারত একজন খুনিকে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি সে খুনিকে দেশে ফেরত না পাঠিয়ে ভারত জুলাই হত্যাকাণ্ডের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরার আহ্বান জানান এ অধ্যাপক।

জুলাই গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর নৈতিকভাবে ভারত চাপে পড়েছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর। আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, জুলাই বিক্ষোভকে এতদিন ভারত একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেছে। জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট প্রকাশের পর ভারতের দাবি এখন মিথ্যা প্রমাণিত। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের বিচারে নৈতিক সমর্থন এবং সহযোগিতা দেওয়া প্রত্যেক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ভারত যদি সেই নৈতিক দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে ভারত গণহত্যার অভিযোগ থেকে দায় এড়াতে পারবে না। হাসিনার বিচার এবং তাকে ভারত থেকে ফেরাতে বাংলাদেশ সরকারের জাতিসংঘের মাধ্যমে আইসিসির সহায়তা নেওয়া উচিত।আমারদেশ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions