ডেস্ক রির্পোট:- ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা ও পরিষেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনায় রেখে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট অর্থাৎ রাজধানী মহানগর সরকার গঠনের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। গতকাল দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জনপ্রশাসন সংস্কার প্রতিবেদন জমা দেন কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীসহ অন্য সদস্যরা। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে যমুনার সামনে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জনপ্রশাসন সংস্কার প্রতিবেদনে সারা দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করা, সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত ও কার্যকর করতে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষা এক বছরের মধ্যে শেষ করা, ডিসিদের পদবি পরিবর্তন করার মতো আরও কিছু সুপারিশও করা হয়েছে।
কমিশন কাজ শুরু করার পর থেকে প্রায় ৪৯টি সভায় মিলিত হয়ে কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশ প্রণয়ন করে। কমিশনের প্রতিবেদনকে মোট ১৭টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ১৪টি বিভিন্ন শিরোনামে দু’শতাধিক সুপারিশ পেশ করা হয়েছে। কমিশন সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের সুবিধার্থে স্বল্পমেয়াদি (৬ মাস), মধ্যমেয়াদি (এক বছর) ও দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ডিসি’র পদবি পরিবর্তন ও মামলা গ্রহণের ক্ষমতা দেয়ার সুপারিশ: জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিদ্যমান পদবি পরিবর্তন করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের নাম ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার’ এবং ইউএনও’র নাম পরিবর্তন করে ‘উপজেলা কমিশনার’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) পদবি পরিবর্তন করে ‘অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভূমি ব্যবস্থাপনা) করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জেলা কমিশনারকে মামলা গ্রহণের ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়, জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর (কোর্ট রেজিস্ট্রার) মামলা প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেয়ার সুপারিশ করা হলো। তিনি অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিশি বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন। পরে মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে চলে যাবে।
কমিশন বলছে, এর ফলে সাধারণ নাগরিকেরা সহজে মামলা করার সুযোগ পাবেন। অন্যদিকে সমাজের ছোটখাটো বিরোধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হয়ে গেলে আদালতের ওপর অযৌক্তিক মামলার চাপ কমবে। তবে এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী একই বিষয়ে পুনরায় আদালতে যেতে পারবেন না। এ সুপারিশের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন: কমিশনের উপজেলা পর্যায়ে দেয়ানি ও ফৌজদারি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুনঃস্থাপনের সুপারিশ করেছে। এ বিষয়ে কমিশন বলেছে এটি করা হলে সাধারণ নাগরিকেরা অনেক বেশি উপকৃত হবে। এ বিষয়েও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেয়ার কথা বলেছে কমিশন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ‘উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা’ পদের সুপারিশ করেছে। কমিশন বলেছে থানার ‘অফিসার ইনচার্জ’-এর কাজ ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার তদারকির জন্য উপজেলা পর্যায়ে একজন সহকারী পুলিশ সুপারকে ‘উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা’ হিসেবে পদায়ন করা যেতে পারে।
দেশের পুরাতন চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এবং সরকারের কার্যপরিধি সুবিস্তৃত হওয়ার ফলে বর্তমান মধ্য প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার কাঠামো যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয় না। অপরদিকে, মেয়াদি এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় মন্ত্রণালয় পর্যায়ে খুঁটিনাটি বহু কাজ সম্পাদন করা হয়। ক্ষমতার প্রত্যর্পণ (ডেলিগেশন) বিবেচনায় দেশে বিশাল জনসংখ্যার পরিষেবা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করার লক্ষ্যে দেশের পুরাতন চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এর ফলে এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা শহরের ওপর চাপ হ্রাস পাবে।
রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও পরিষেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনায় রেখে দিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট বা রাজধানী মেয়াদি মহানগর সরকার (Capital City Government) গঠনের সুপারিশ করা হলো। অন্যান্য প্রদেশের মতো এখানেও নির্বাচিত আইন সভা ও স্থানীয় সরকার থাকবে। ঢাকা মহানগরী, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্টের আয়তন নির্ধারণ করা যেতে পারে।
জেলা পরিষদ বাতিল: স্থানীয় সরকারের একটি ধাপ হিসেবে জেলা পরিষদ বহাল থাকবে কিনা, সে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা রয়েছে। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কখনোই নাগরিকদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হননি। কিছু জেলা পরিষদ বাদে অধিকাংশেরই নিজস্ব রাজস্বের শক্তিশালী উৎস নেই। ফলে অধিকাংশ জেলা পরিষদ আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সেহেতু জেলা পরিষদ বাতিল করা যেতে পারে। জেলা পরিষদের সম্পদ প্রস্তাবিত সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক সরকারকে হস্তান্তর করা যেতে পারে।
তথ্য অধিকার আইন: নাগরিকরা যাতে সহজে ও অবাধে চাহিদামতো সরকারি সেবা সংক্রান্ত তথ্য পেতে পারে সেজন্য তথ্য অধিকার আইন (Right to Information Act, ২০০৯) এবং Official Secrets Act, ১৯২৩ পর্যালোচনা ও সংশোধন করা যেতে পারে। Right to Information Act, ২০০৯- এর একটি সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া সংযুক্তি-৪-এ রাখা হয়েছে। নাগরিকদের তথ্য ও পরিষেবায় অভিগম্যতা সহজ করার জন্য পরবর্তী অধ্যায়েরও সুপারিশ করা হয়েছে।
দেশের নাগরিকদের সহজে পাসপোর্ট দেয়া একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। পাসপোর্ট দেয়ার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন কার্যক্রম বাতিল করার জন্য সুপারিশ করা হলো। কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রে আপত্তি থাকলে তাকে বিমানবন্দরেই যাচাই করা যেতে পারে। তাছাড়া পুলিশের হাতে ফৌজদারি মামলার আসামিদের তালিকা অনলাইনে সহজলভ্য থাকতে পারে।
দুর্নীতি বন্ধঃ জনসেবা ব্যবস্থার মধ্যে ঘুষ, পক্ষপাতিত্ব এবং স্বজনপ্রীতির কারণে সেবা প্রদান প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। সুতরাং জনসেবায় দুর্নীতি বন্ধে সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
জনসেবার বিরাজনীতিকীকরণঃ দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনসেবা প্রদান নিশ্চিতের জন্য এসব কার্যক্রমে রাজনৈতিক পক্ষপাত এবং দলগত বিবেচনা পরিহার করতে হবে।
মন্ত্রণালয়গুলোর সংখ্যা হ্রাস করা: বর্তমানে মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৬১টি বিভাগ রয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোকে যুক্তিসংগতভাবে হ্রাস করে কমিশন সরকারের সকল মন্ত্রণালয়গুলোকে মোট ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাস করার সুপারিশ করছে। মন্ত্রণালয়গুলোকে হ্রাস করার প্রস্তাবের সংযুক্তি-৫-এ রাখা হয়েছে।
নতুন দু’টি বিভাগ গঠন: বর্তমানে দেশে মোট ৮টি প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে। ভৌগোলিক ও যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনায় কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগ গঠনের দাবি অনেক দিনের। সুতরাং কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দু’টি নতুন বিভাগ গঠন করার সুপারিশ করা হলো। জনসংখ্যা ও যোগাযোগের বিবেচনায় দশটি বিভাগকে পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাবের বিবরণ সংযুক্তি-৭-এ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পুনর্গঠন: (ক) বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)-এর আওতায় একীভূত (টহরভরবফ) ‘ক্যাডার’ সার্ভিস বাতিল করে তার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের কাজের ধরন ও বিশেষায়িত দক্ষতার বিষয়টি সামনে রেখে আলাদা আলাদা নামকরণ করা যেতে পারে। বিদ্যমান বিসিএস-এর বিভিন্ন ক্যাডারগুলোকে নিম্নলিখিত ১২টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি ক্রয়ের লোন: সচিবালয়ের উপ-সচিবদের গাড়ি ক্রয়ের ঋণ এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০,০০০ টাকা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। এ সুযোগ সচিবালয়ের বাইরে অন্যান্য সার্ভিসের কর্মকর্তাদের জন্য নেই। এ ব্যবস্থা বাতিল করার জন্য সুপারিশ করা হলো। এতে একদিকে বৈষম্য দূর হবে এবং অপরদিকে, সরকারের ব্যয় হ্রাস পাবে।
অবসর নেয়ার অনুমতি: প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী ১৫ (পনের) বছর চাকরি করার পর সকল সুবিধাসহ অবসর নেয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হলো। এটি কর্মজীবন পরিবর্তনের জন্য বেছে নেয়া কর্মকর্তাদের জন্য একটি প্রস্থান পথের সুবিধা দিবে।
ঢাকার বাইরে বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান: বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্থাপনের ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার বাইরের স্থানগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।মানবজমিন