ডেস্ক রির্পোট:- ৪০তম বিসিএসে ৭১ জন সহকারী পুলিশ সুপার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৬২ জনই ছাত্রলীগের। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর তাদের সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছে। তবে এই বিসিএসে কেবল পুলিশ ক্যাডারের সহকারী পুলিশ সুপার পদই নয়, সহকারী কমিশনার (প্রশাসন), সহকারী পরিচালক (আনসার), সহকারী মহা-হিসাবরক্ষক, সহকারী নিবন্ধক (সমবায়), সহকারী কমিশনার (শুল্ক ও আবগারি), সহকারী সচিব (পররাষ্ট্র বিষয়ক), সহকারী কমিশনার (কর) সহ প্রায় সবকটি ক্যাডারেই বেছে বেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এদের বাইরে মেধার জোরে ভাগ্যক্রমে কেউ নিয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে শেষ পর্যন্ত তাদের অনেককেই আটকে দেয়া হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের ট্যাগ দিয়ে। পুলিশের ইস্যুটি সামনে আসার পর এখন ভুক্তভোগীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওই নিয়োগের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে তাদের লাঠিয়াল বাহিনীকে নিয়োগ দেয়ায় ৪০তম বিসিএস বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তারা।
জানা যায়, ২০২২ সালের ১ নভেম্বর ৪০তম বিসিএসে ১ হাজার ৯২৯ জনকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং ৪ ডিসেম্বর যোগদান করতে বলা হয়। এতে বলা হয়, নিয়োগপ্রাপ্তদের দুই বছর শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে হবে। এই সময়ে কেউ চাকরিতে বহাল থাকার অনুপোযোগী বিবেচিত হলে কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই এবং সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শ ছাড়াই তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা যাবে। প্রজ্ঞাপনের এই শর্তের তথ্য উল্লেখ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেন, ৪০তম বিসিএসে যেসব ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চাকরি দেয়া হয়েছে, সরকার চাইলে অতিদ্রুত তদন্তের মাধ্যমে তাদের বাদ দিতে পারে। স্বৈরাচারের কোন দোসরকে আমরা আর মেনে নেবো না। তদন্ত করে যাদের সমস্যা নেই তারা নিয়োগ পাক, আমরা স্বাদরে গ্রহন করবো। আর সরকার যদি এই উদ্যোগ গ্রহণ না করে তাহলে তারা রাজপথে নামতে বাধ্য হবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. মো. গোলাম আজম বলেন, বিসিএস বাতিল কিংবা অন্য কোন বিষয় নিয়ে এখনো কোন আলোচনা হয়নি। তিনি জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
এই বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার পদে ২৪৪ জন, আনসার ক্যাডারে সহকারী পরিচালক/সকারী জেলা কমান্ড্যান্ট/ব্যাটালিয়ন উপ-অধিনায়ক পদে ১২ জন, নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারে সহকারী মহা-হিসাবরক্ষক পদে ৪৪ জন, সমবায় ক্যাডারে সহকারী নিবন্ধক পদে ১৭ জন, শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে সহকারী কমিশনার পদে ৭২ জন, খাদ্য ক্যাডারে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদে ৩ জন, পররাষ্ট্র ক্যাডারে সহকারী সচিব পদে ২৪ জন, তথ্য ক্যাডারে সহকারী পরিচালক/তথ্য অফিসার/গবেষণা কর্মকর্তা পদে ১৩ জন, অপর ক্যাডারে ৪ জন, পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার পদে ৭১ জন, ডাক ক্যাডারে সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল পদে ৬ জন, রেলওয়ে ক্যাডারে ১ জন, কর ক্যাডারে সহকারী কমিশনার পদে ৫৯ জন, কৃষি ক্যাডারে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা পদে ২৪৫ জন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে ২৩ জন, মৎস্য কর্মকর্তা পদে ২৫ জনসহ অন্যান্য ক্যাডারে বাকীদের নিয়োগ দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেন, ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে ২৪৪টি পদের মধ্যে অন্তত ২০০ জনই নিয়োগ পেয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হিসেবে। একইভাবে অন্যান্য ক্যাডারেও সংখ্যাগরিষ্ট সংখ্যক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগ কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা কিংবা এমপি-মন্ত্রীদের কোটায়।
তারা বলেন, ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতা গণভবন দখলে নিলে সেখানে বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় কাদের নিয়োগ দেয়া হবে সেই সুপারিশ এবং তালিকা পাওয়া যায়। এবং যেসব তালিকা পাওয়া গেছে তাদের সকলকেই নিয়োগও দেয়া হয়েছে। এ থেকে বুঝতে বাকি থাকে না সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়া কিভাবে কাজ করতো এবং কাদের নিয়োগ দেয়া হতো। ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের বাইরে হলে তাদের কপালে বেকারত্বের বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই জুটতো না।
তাসমিন ইমা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ৬২ জন কর্মকর্তার নিয়োগ যদি অনিয়ম করে হয় তাহলে ৪০তম বিসিএসের অন্য ক্যাডারগুলোতে কি একই ধরণের অনিয়ম ও ছাত্রলীগ থাকার কথা নয়? আমার জানা মতে প্রশাসন ক্যাডারে সর্বোচ্চ সংখ্যক ক্যাডার নিয়োগ দেয়া হয়। অনিয়ম হলে তো সবগুলো ক্যাডারে হওয়ার কথা! দরকার হলে ৪০ তম বিসিএস পুরোটাই বাতিল করে দেওয়া উচিত!
আব্দুস সালাম শিমুল নামে এক চাকরি প্রার্থী বলেন, ফ্যাসিবাদের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত সকল সরকারি ক্যাডারদের পুনঃতদন্ত করে নিয়োগ দেয়া উচিত। প্রয়োজনে আমরা আবারো আন্দোলনে নামবো।
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর ৪০তম বিসিএস থেকে বাতিল হয়ে যায় দৃশ্যমান কোটা পদ্ধতি। তবে আগের মতো দাপট ছিল ‘ছাত্রলীগ নামক অদৃশ্য কোটার’। পতিত হাসিনা সরকারের সময়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হতো বেছে বেছে। সর্বোচ্চ নিয়োগ প্রতিষ্ঠান পিএসসি থেকে একেবারে নিচু পদের দারোয়ান নিয়োগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হতো। চেতনা রক্ষার নামে দলীয় লোকজন ও স্বজনদের নিয়োগ দেয়া হতো। আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শের বাইরে কেউ বিশেষত সরকারের উঁচু পদে নিয়োগ দুষ্কর ছিল। মেধার জোরে ভাগ্যক্রমে কেউ নিয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে শেষ পর্যন্ত তাদের অনেককেই আটকে দেয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দিয়ে দেশের হাজারো তরুণ যুবককে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সাবেক জনপ্রশাসন উপদেষ্টা মরহুম এইচ টি ইমাম ২০১৪ সালে ছাত্রলীগকে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তোমরা লিখিত পরীক্ষা দাও বাকিটা আমরা দেখব। আওয়ামী লীগ রেজিমের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতিবিষয়ক এই উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতির পর সরকারি চাকরির বাজারে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিসিএস চাকরি মানেই যেন হয়ে গেছে ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মীয়-স্বজনকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়া। গত এক যুগ কার্যত বিএনপি ও জামায়াত পরিবারের সন্তানদের জন্য ‘বিসিএস চাকরি নিষিদ্ধ’ ছিল। সাধারণ ঘরের মেধাবী ছেলেমেয়েরা মেধায় উপরের দিকে থাকলে কদাচিৎ চাকরি হতো। বাকী পদ হয় কোটায় নয়তো ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দিয়ে পূরণ করা হতো। এই রেওয়াজ চলে আসছে অনেকদিন থেকে।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বলেছিলেন, বাংলাদেশের যেকোনও চাকরি করতে হলে ছাত্রলীগ করতে হবে; অন্যথায় লিখিত বা মৌখিকে পাস করলেও কারো চাকরি হবে না। এনএসআই, ডিজিএফআই, এসবির লোকজন ছাত্রলীগার না হওয়ার কারণে পাস করলেও বাদ দিবে। শুধু নিজে ছাত্রলীগ নয়, নিজের পিতাকেও আওয়ামী লীগের রাজনীতি হতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ছাত্র না হলে সেই ছেলে বিসিএস ক্যাডার হবে না, সে চাকরি পাবে না। এখন বাংলাদেশে চাকরি করতে হলে তাকে অবশ্যই ছাত্রলীগ করতে হবে। তার মা-বাবাকে অবশ্যই আওয়ামী লীগ করতে হবে। তা না হলে এনএসআই, ডিজিএফআই, ডিএসবি এসব গোয়েন্দা শাখায় তোমার রেজাল্টে তুমি রিটেন ও মৌখিক পাস করলেও তোমার বাবা-মা যদি আওয়ামী লীগ না হয়, তোমার পরিবার যদি আওয়ামী না হয়, তুমি যদি ছাত্রলীগ না হও তাহলে তোমাকে কোন অবস্থায় চাকরি দিবে না।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পতিত সরকারের সন্ত্রাসী পেটোয়া ছাত্রলীগকে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জায়গা করে দিতে পিএসসির নিয়োগ বোর্ডগুলো কাজ করেছে। ওই সরকারের আমলে পিএসসির মাধ্যমে প্রশাসন পুলিশসহ গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারে বাছাই করে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট লোকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর এ কাজ করতে গিয়ে সব ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস, আলাদা করে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা, ভাইবাতে আলাদা করে বেশি নম্বর পাইয়ে দেয়া হয়েছে। নিজের লোকদের নির্বাচিত করার স্বার্থে লিখিত পরীক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রার্থীকে পাস করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার পুলিশের কুচকাওয়াজ স্থগিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, আমার অভিযোগের জায়গা শুধু এটাই। হাসিনার গোপালগঞ্জ কোটা, ক্যাডার কোটায় দেশের প্রতিটা কোনায় বসে আছে এখনো। তাদের সরানো বাদ দিয়ে আরও ৬২জনকে আমরা জয়েন করতে দিবো? আমাদের শহীদদের সাথে বেইমানী করা হবেনা এটাতে? তদন্ত করে যাদের সমস্যা নেই তারা নিয়োগ পাক, আমরা স্বাদরে গ্রহন করবো।
মোহাম্মদ নাসিম উদ্দীন নামে আরেকজন লেখেন, ৪০ তম বিসিএস পুলিশে ৬২ জনই ছাত্রলীগ, গোপালগঞ্জ ও শেখ হাসিনার কার্যালয়ের কোটার লোক! ভাবা যায়? তাইতো ভাবি এত ভাল এক্সাম, ভাইভা দিয়েও আমাদের নন-ক্যাডার আসে আর ওদিকে যদু মদু নসু হয়ে যায় পুলিশ এডমিন ক্যাডার! আরেকটা ভয়ংকর বিষয় হলো, ১৮ সালের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কোটা বাদ দিলেও, এটা ছিলো শুধুমাত্র একটা ধোঁয়াশা, মূলত প্রতি বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং ছাত্রলীগ কোটা ছিলো। ৩৮ তম বিসিএস থেকে আবেদন ফর্মে কিন্তু কোটার অপশন ছিলো, এমন না যে এখনকার মতো ৭% কোটা আছে তাই অপশন দরকার ছিলো, কিন্তু ওই সময় কোনো কোটা ছিলোনা। মূলত হাসিনা দুইটা টার্গেট রাখতো।
১. ছাত্রলীগের ছেলেদের টার্গেট করে নির্দিষ্ট ক্যাডারে ইনক্লুড। এই ক্ষেত্রে পুলিশ এবং ট্যাক্স ক্যাডার প্রাধান্য। প্রশাসনের চেয়ে ট্যাক্স ক্যাডারকে বেশি গুরুত্ব দিতো হাসিনা। ২. মুক্তিযোদ্ধা কোটা যাদের আছে তাদের অন্যান্য ক্যাডারে ইনক্লুড। বিশেষ করে প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্যাডারে।
পুলিশে ছাত্রলীগের নিয়োগ দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে রেজাউল করিম নামে এক শিক্ষার্থী ৪০তম বিসিএসের পুরো নিয়োগ বাতিল করার দাবি জানান। তিনি বলেন, এক পুলিশেই যদি এই পরিমাণ ছাত্রলীগকে নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে অন্য ক্যাডারগুলোতে কি ছেড়ে দেয়া হয়েছে? তা নিশ্চয় নয়। তাই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের রক্তাক্ত হাতিয়ার ছাত্রলীগের সকল নিয়োগ বাতিল করতে হবে।
এবিষয়ে কথা বলার জন্য পিএসসির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোবাশ্বের মোনেমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে পিএসসির এক কর্মকর্তা বলেন, ৪০ তম বিসিএস এর প্রজ্ঞাপন যেহেতু হয়ে গেছে তাই এটি এখন মন্ত্রণালয়ের বিষয়। এছাড়া নিয়োগের শর্তেও উল্লেখ আছে মন্ত্রণালয় চাইলে পিএসসির পরামর্শ ছাড়াই নিয়োগ বাতিল করতে পারবে। ইনকিলাব