মামলা, গ্রেপ্তারে অস্বস্তি পুলিশ ও প্রশাসনে

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৩২ দেখা হয়েছে

সাবেক শীর্ষ ৬ আমলা ও ১৭ পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তার।
প্রশাসন-পুলিশের চার শতাধিক কর্মকর্তা আসামি।
প্রশাসনের আড়াই শতাধিক কর্মকর্তা ওএসডি।
পদক্ষেপ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যেও দুই মত।

ডেস্ক রির্পোট:- সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা, গ্রেপ্তার, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রভাবশালী দুটি অঙ্গ—প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে অস্বস্তি বিরাজ করছে। এর মধ্যেই প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে গুঞ্জন চলছে, বিগত নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের একটি অংশকেও আইনের আওতায় আনা হবে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে কর্মকর্তাদের একপক্ষ মনে করছে, সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের ঢালাওভাবে মামলায় আসামি করা ও গ্রেপ্তার সার্বিক কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে আরেকটি অংশের মত, বিগত সরকারের আমলে যেসব আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তা বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন ও দলীয় আবরণে গা ভাসিয়েছেন, তাঁদের বিচারের মুখোমুখি না করলে পুরো প্রশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিশোধমূলক। এটা ২০ বছর ধরে ঘৃণ্যভাবে চলেছে। এর জন্য দুটি বড় রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) সমানভাবে দায়ী। তবে আওয়ামী লীগের আমলে এর মাত্রা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ছিল।

তিনি বলেন, ‘যেভাবে মামলা দেওয়া হচ্ছে, এর মধ্যে কতগুলো সঠিক, তা আমার জানা নেই। যতটুকু বুঝি, এর অধিকাংশ ভুয়া। যদি তা-ই হয়, তাহলে এসব মামলা দিয়ে হেনস্তা করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে বিএনপিকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিল, এখন তারাও সেটিই করছে।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য, সাবেক এমপি, দলীয় নেতাদের পাশাপাশি পুলিশ ও প্রশাসনের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদেরও আসামি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব, সচিব, পুলিশের সাবেক চার আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নামে মামলা হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়া শতাধিক সরকারি কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করা অন্তত ছয়জন সাবেক আমলা, সাবেক দুই আইজিপিসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছেন। রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে কয়েকজনকে।

জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ের তিনজন মুখ্য সচিব যথাক্রমে নজিবুর রহমান, কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও আবুল কালাম আজাদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খান, সাবেক জননিরাপত্তা সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়াসচিব মেজবাহ উদ্দীন আহমেদকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একাধিক হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ও আহমেদ কায়কাউস, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ও ফয়েজ আহমেদ এবং সাবেক সচিব আনিসুর রহমান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার। তাঁদের কারও কারও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

সর্বশেষ ৯ অক্টোবর জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্য ফাঁস ও বিক্রির অভিযোগে কাফরুল থানায় সাইবার নিরাপত্তা আইনের মামলায় আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম, আইসিটি বিভাগের সাবেক উপসচিব তবিবুর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক উপসচিব মো. রেজাউল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মামলায় সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, এসব মামলা নিয়ে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তুলনামূলক কম অভিযোগ থাকা উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা ও গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ রয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে একজন কর্মকর্তা সরকারের দেওয়া আদেশের বাইরে গিয়ে খুব একটা কাজ করতে পারেন না। ফলে যখন যে সরকারের থেকেছে, তাদের হয়েই কর্মকর্তাদের কাজ করতে হয়েছে।

তবে বিষয়টি মানতে নারাজ প্রশাসন ক্যাডারেরই আরেকটি অংশ। এই অংশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও একটি অংশ দলীয় পরিচয় গায়ে মাখিয়ে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। তারা একটি দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতা করেছে। ফলে তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। তা না করা হলে এমনভাবে সময়ে সময়ে বেপরোয়া কর্মকর্তার আবির্ভাব ঘটতে থাকবে।

সূত্র জানায়, বিগত সরকারের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গ্রেড-১ ভুক্ত এবং অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন স্তরের কমবেশি আড়াই শতাধিক কর্মকর্তা ওএসডি আছেন। সিনিয়র সচিব, সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এত কর্মকর্তাকে একসঙ্গে এর আগে কখনো ওএসডি করে রাখা হয়নি। ফলে বিভিন্ন দপ্তরের শীর্ষ পদ ফাঁকা হয়ে আছে এবং এসব পদে যোগ্য কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া নিয়েও সাময়িক সংকট তৈরি হয়েছে।

এদিকে পুলিশের সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশ জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে; যা চলে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। পুলিশের নির্মমতা মানুষকে বেশি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এর ফলে সরকারের পতনের পর পুলিশ সদস্য ও পুলিশের স্থাপনায় ব্যাপক হামলা, অগ্নিসংযোগ হয়। জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিভিন্ন হত্যার ঘটনায় করা একের পর এক মামলায় পুলিশ কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এ নিয়ে বাহিনীটিতে আতঙ্ক ও ভাবমূর্তির সংকট তৈরি হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৩০১টি মামলায় সাবেক ও বর্তমান ৪৫১ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২৬ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ৪২ পুলিশ সুপার, ১১ উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), ২০ অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এবং চারজন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) রয়েছেন। এ ছাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), পরিদর্শক, উপপরিদর্শক, সহকারী উপপরিদর্শক ও কনস্টেবলও রয়েছেন। সাবেক দুই আইজিপিসহ ১৭ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন সাবেক দুই আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হক, অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ডিএমপির ডিবির সহকারী কমিশনার ইফতেখার মাহমুদ, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক দুই ওসি আবুল হাসান ও মাজহারুল ইসলাম, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এএসআই মো. আমির হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়সহ কয়েকজন।

এই কর্মকর্তাদের সর্বনিম্ন পাঁচ দিন থেকে কয়েক দফা মিলিয়ে ৬০ দিন পর্যন্ত রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সদ্য সাবেক আইজিপি মামুনকে ৪৩ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়। সাবেক পুলিশপ্রধান শহীদুল হককে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, ‘পুলিশ বা আমলা যে-ই হোক না কেন, তারা চাকরিবিধি, নিয়মনীতির মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করলে হয়তো এসব সংকটে পড়তে হতো না। যাদের যে কাজের জন্য রাষ্ট্র নিয়োগ দিয়েছে, তারা অন্য কিছু না করে সে কাজটিই সঠিকভাবে করলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে না।’আজকের পত্রিকা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions