ডেস্ক রির্পোট:- কোটাবিরোধী আন্দোলন কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সহিংসতার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে দল ও সহযোগী সংগঠনের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। সেইসঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। টানা তিন মেয়াদ সরকার পরিচালনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করলেও দুর্বল হয়েছে দলের সাংগঠনিক অবস্থা। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রভাবে দলীয় নেতাকর্মীদের আদর্শিক দৃঢ়তা ও ত্যাগের মানসিকতায় বড় রকমের ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলেও আলোচনা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বস্তরে সাংগঠনিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে। দলের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বেশ কিছু কারণও সামনে আসছে। এর মধ্যে বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত সম্মেলন না হওয়া, নানা কারণে ত্যাগী ও নিবেদিত কর্মীদের অভিমানে সরে যাওয়া, কমিটিতে হাইব্রিডদের প্রাধান্য, নেতৃত্ব নির্বাচনে আর্থিক লেনদেনের প্রবণতা, যোগ্যদের বঞ্চিত করা এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ও স্বজনপ্রীতি অন্যতম।
দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বলেন, ‘দুর্বলতা আছে অস্বীকার করার উপায় নেই। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের শৈথিল্য এসেছে। তাদের মধ্যে আন্দোলন করার চেতনা নষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি অনেকে অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াই করার সাহসও হারিয়েছে। তবে দুর্বল থেকে সবল করার উপায়ও আছে। সেই পথে আওয়ামী লীগ হাঁটছে।’
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের সুযোগে বিএনপি-জামায়াত ও এবি পার্টি দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াওসহ সহিংসতা ছড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি। রাজধানীসহ সারা দেশেই সাংগঠনিক সক্ষমতা ও ঐক্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।
সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা খোদ দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বিভিন্ন বৈঠকে উল্লেখ করেছেন। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নানা দুর্বলতা বেরিয়ে এসেছে বলে স্বীকার করে নেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের ওপর ক্ষোভও ঝাড়েন। ছাত্রলীগ ফাঁপা বেলুনের মতো চুপসে গেছে, রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের।
তার মতে, সহিংস পরিস্থিতিতে এমপিরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, কাউন্সিলরদের মধ্য সমন্বয় ছিল না। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মোহাম্মদপুরে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে হতাহতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেসব এলাকায় দলের দুর্বলতার কথাও বলেছেন তিনি। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড ও থানা কমিটি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দোষারোপও করেন। এমনকি এই মুহূর্তে মহানগরের কমিটি দিলে নিজেদের মধ্যেই আগুন জ্বলবে বলেও আশঙ্কা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, সংগঠনের এই বাজে অবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় নেতা থেকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষ নেতারাই দায়ী। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে অতীত ভুলে গিয়ে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে দিয়ে হাইব্রিডদের জায়গা করে দিয়েছেন। অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন কমিটিতে পদায়ন করেছেন। নামমাত্র সম্মেলন করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি দিয়েছেন। দল ভারী করার জন্য বিএনপি-জামায়াতের অভয়ারণ্য বানিয়েছেন আওয়ামী লীগকে।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘ঢাকা মহানগরের মতো শাখায় যুবলীগের কমিটি নেই, সম্মেলন হয় না এক দশকের বেশি। গত পৌনে পাঁচ বছরে এই যুব সংগঠনের তেমন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই, সারা দেশে গুটিকয় শাখায় সম্মেলন দিয়ে কিছু জায়গায় কমিটি করেছে। তাহলে সংগঠন শক্তিশালী হবে কীভাবে? ছাত্রলীগের কমিটি তো টাকা দিলেই হয়। অন্যান্য সংগঠনের অবস্থা একই রকম সঙ্গিন। দলের খুঁটি ও প্রাণকেন্দ্র হলো ঢাকা মহানগর। অথচ থানা ও ওয়ার্ডে নেই কোনো কমিটি। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক নিজেদের মতো করে স্বজনপ্রীতি করে কমিটি জমা দিয়েছেন। অর্থের বিনিময়ে পদ দেওয়ার অভিযোগের অডিও ফাঁস হয়েছে। দুর্দিনের কর্মীদের অমর্যাদা করে দুধের মাছিদের দলে জায়গা দিলে দলের অবস্থা এরকম হওয়া অস্বাভাবিক নয়।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে, সংগঠনে দুর্বলতা আছে। যারা এই দুর্যোগকালীন সময়ে দলের সঙ্গে ছিল না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। দলীয় ঐক্যে প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। সহযোগী সংগঠনের শক্তি বাড়াতে যা যা করণীয় তা করা হবে। একই সঙ্গে যারা এই দুঃসময়ে দলের সঙ্গে ছিল না, তারা রাজনৈতিক অপরাধ করেছে। এর খেসারত দলকে দিতে হয়েছে, আওয়ামী লীগও এর হিসাব কড়ায়-গণ্ডায় নেবে।’
এদিকে দলের সাংগঠনিক সমস্যা আঁচ করতে পেরে রাজধানীসহ সারা দেশেই দলকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ওবায়দুল কাদের। আত্মসমালোচনা করে সেই বৈঠকে দলকে ঐক্যবদ্ধ করার বার্তা দেন। এরপর থেকে রাজধানীতে বিভিন্ন ওয়ার্ড, সংসদীয় আসনভিত্তিক বৈঠক করছেন।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় সমন্বয়হীনতা কাটাতে বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন। জনসমক্ষে কথা বলার ক্ষেত্রে নেতাদের সচেতন হওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন। কারফিউ ও কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা নেতা ছাড়া অন্য কাউকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। দলীয় ইমেজ পুনরুদ্ধার ও গণভিত্তি বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কারফিউ তুলে নেওয়ার পর তৃণমূলকে চাঙ্গা করতে কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা সফরে যেতে পারেন বলেও ইঙ্গিত মিলেছে।কালবেলা