ডেস্ক রির্পোট:- বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সরব বিশ্ব গণমাধ্যম। ছাপা সংস্করণ পত্রিকা, ডিজিটাল সংস্করণ এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে সংবাদ ও সংবাদ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে নিউ ইয়র্ক টাইমস, ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য হিন্দু, পাকিস্তানের ডন, বিবিসি, আল জাজিরা, ফরেন পলিসি সহ সুপরিচিত এবং কম পরিচিত সব গণমাধ্যম। এসব রিপোর্টে উঠে আসছে নানা তথ্য। কীভাবে বাংলাদেশে এই সংকটের সৃষ্টি, এর জন্য দায়ী কে বা কারা- এসব প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। ‘ড্রেঞ্চড ইন ব্লাড- হাউ বাংলাদেশ প্রটেস্টস টার্নড ডেডলি’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিসি। এতে বলা হয়, সরকারবিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ সারা দেশে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এতে কমপক্ষে ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। একজন শিক্ষার্থী বলেছেন, বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণ র্যালি করতে চেয়েছিলেন রাজধানী ঢাকায়। কিন্তু তারা সমবেত হওয়ার পর তাদের ওপর পুলিশ হামলা চালিয়ে সেই র্যালি ভণ্ডুল (রুইন্ড) করে দেয়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক ছাত্রনেতা বর্ণনা করেছেন কীভাবে তাকে তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয় এবং নির্যাতন করে- যারা এটা করে তারা পুলিশ হতে পারে বলে দাবি তার।
ওদিকে জরুরি বিভাগের একজন ডাক্তার বলেছেন, সংঘর্ষের চূড়ান্ত সময়ে কয়েক ডজন তরুণ বা তরুণীকে তাদের কাছে নেয়া হয়। তারা গুলিতে আহত হয়েছেন। রিপোর্টে আরও বলা হয়, অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ করা হচ্ছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু অসন্তোষের জন্য রাজনৈতিক বিরোধীদের দায়ী করেছে সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলনে এই অসন্তোষ দেখা দেয়। সরকারি চাকরির এই কোটার বহুলাংশ বাতিল করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে। ওদিকে গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার থেকে দেশ জুড়ে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট চলছে। ফলে দেশে তথ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কয়েক হাজার সেনা নামিয়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে ইন্টারনেট সংযোগ সীমিতভাবে পুনঃস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংক, প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া আউটলেটের মতো কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। গত জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান সরকার। ওই নির্বাচন প্রধান বিরোধী দলগুলো বর্জনের মধ্যদিয়ে ব্যাপক বিতর্কিত নির্বাচনে পরিণত হয়। তারপর এই সহিংসতা তাদের সামনে সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ। ভারতের টেলিগ্রাফ পত্রিকা ‘কাম্ ডাউন’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে ২৩শে জুলাই। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ছাত্রদের বিক্ষোভ শুরুতে শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু প্রতিবাদীদের সঙ্গে পুলিশ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের ভয়াবহ সংঘর্ষের ফলে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সহিংসতায় কমপক্ষে ১০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট সংরক্ষিত কোটা সংকুচিত করে রায় দিয়েছেন। কিন্তু উত্তেজনায় কারফিউ বহাল আছে। রাজপথে নিরাপত্তারক্ষীরা প্রহরা দেন। ইন্টারনেট পুরোপুরি ব্ল্যাকআউট করে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা এখন তাদের নিহত সহযোদ্ধাদের হত্যার বিচার দাবি করছেন। কিন্তু সরকার দাবি করছে, বিরোধী দলগুলো বিক্ষোভকারীদের উস্কানি দিয়েছে। কিন্তু যা পরিষ্কার, তা হলো- প্রান্তসীমায় বা কিনারায় বাংলাদেশ। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশটিকে বিক্ষোভের আগের অবস্থায় ফেরা খুব কঠিন হবে, যদি না উভয় পক্ষ- বিশেষ করে সরকার গুরুতর ছাড় না দেয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রভাবশালী এবিসি নিউজের ২৪শে জুলাইয়ের সংবাদ শিরোনাম- ‘হোয়াই স্টুডেন্টস আর রিস্কিং দেয়ার লাইভস টু টেক অন দ্য বাংলাদেশি গভর্নমেন্ট’। ম্যাক ওয়ালডেন এবং জুলিয়া বারগিনের লেখা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে কমপক্ষে ২৫০০ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশটি প্রায় এক সপ্তাহ রয়েছে ইন্টারনেটবিহীন। এমন অবস্থায় জনগণের ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দমনপীড়ন বন্ধের জন্য এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ চালুর জন্য কর্তৃপক্ষকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা।
বুধবার আংশিক যোগাযোগ চালু করেছে সরকার। কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ খুব ধীরগতির। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধই রয়েছে।’ কেন এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠেছে তার বিশ্লেষণ করা হয়েছে রিপোর্টে। এতে বলা হয়, ‘প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ গ্র্যাজুয়েট সরকারি চাকরির প্রায় ৩ হাজার পদের জন্য প্রতিযোগিতা করেন। এক্ষেত্রে কোটা রেখে সরকার তার সমর্থকদের সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কুন্তলা লাহিড়ী দত্তের মতে- ‘এরই মধ্যে দানব মুক্ত হয়ে পড়েছে’ (দ্য ডেমন হ্যাস বিন আনলিশড অলরেডি)। এই রিপোর্টের একটি উপ-শিরোনাম- ক্ষোভের একমাত্র কারণ কি কোটা ব্যবস্থা? এ প্রশ্ন করেই উত্তরে বলা হচ্ছে- না। বর্তমান সরকারের অধীনে অর্থনীতি, দুর্নীতি এবং কর্তৃত্বপরায়ণতায় ব্যাপক হতাশা জনগণের বিক্ষোভে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রফেসর লাহিড়ি দত্ত আরও বলেন- বর্তমান সরকার অনেক লম্বা সময় দেশ শাসন করছেন। ক্ষমতাসীন দলটিতে উত্তরসূরির পরিকল্পনা নেই। অন্য দলগুলোতে শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ নেই। তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। সেটা বিস্ফোরিত হয়েছে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। ফরেন পলিসিতে ‘দ্য ডিপ রুটস অব বাংলাদেশজ ক্রাইসিস’ রিপোর্টে সাংবাদিক সলিল ত্রিপাঠি লিখেছেন, চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে ছাত্রদের গণআন্দোলন বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের ১৫ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে বিদ্রোহে পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহের রোববার বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস হত্যাযজ্ঞ বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন। এই আন্দোলনের সঙ্গে সমর্থন জানিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বৃটেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর আলী রীয়াজের মতে, ‘এই আন্দোলন এ যাবৎ বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ ও গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।’
কীভাবে এটা ঘটেছে? উত্তর আছে কোটা ব্যবস্থার গভীরে এবং এর সঙ্গে সরকার ও তার দলের সংযোগ থাকায়। কিন্তু এই অস্থিরতার মূল কারণ আরও অনেক গভীরে। কারণ অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে হতাশা, ভয়াবহ দুর্নীতি, জালিয়াতির নির্বাচন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন সামনে চলে এসেছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসে ‘অ্যান আনবেন্ডিং লিডার্স ক্র্যাকডাউন রেইনস কারনেজ অন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন লিখেছেন সাংবাদিক মুজিব মাশাল। তিনি নয়াদিল্লি থেকে রিপোর্ট করেছেন। দীর্ঘ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতার যে ফর্মুলা তার বিরুদ্ধে এ মাসের প্রতিবাদ বিক্ষোভ একটি বড় আঘাত। এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত দমনপীড়ন চালানো হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১৫০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। এর ফলে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র কয়েক মাস পরেই প্রাধান্য বিস্তার করা সরকারের জন্য সৃষ্টি হয়েছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য বিশ্লেষকরা দায়ী করছেন শীর্ষ মহলকে। এমন দমনপীড়নকে কূটনীতিকরা এবং বিশ্লেষকরা নৃশংসতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশে এটা অপ্রত্যাশিত। ফলে অনেক বাংলাদেশি সীমা অতিক্রম করেছেন। তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা গেছে তা সহসা মিইয়ে যাবে বলে মনে হয় না। কূটনীতিক ও কর্মকর্তারা বলছেন নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ১৫০। কিন্তু স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর হিসাবে এই সংখ্যা ২০০-এর কাছাকাছি। আন্দোলনকারী ছাত্রনেতারা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েক গুণ। শুধু ঢাকার জেলেই রাখা হয়েছে কয়েক শত মানুষকে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, আন্দোলন দমাতে প্রতিটি বাহিনীকে রাজপথে মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে আধা-সামরিক বাহিনী। এর কিছু কর্মকর্তা এর আগে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও জোরপূর্বক গুমের অভিযোগে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছেন।
একটি বিশেষ বাহিনীকেও দেখা গেছে রাস্তায়। বিরোধীদের অভিযোগ, ক্ষমতার মেয়াদকে বাড়াতে আইনপ্রয়োগকারীদের ব্যবহার করেছে সরকার। মুজিব মাশাল আরও লিখেছেন, সরকার গৃহীত ব্যবস্থার প্রতিবাদ জানাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বিদেশি কূটনীতিকদের একটি গ্রুপ। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী ছাত্রদের প্রতিবাদ বিক্ষোভকে দমনপীড়ন করতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের কাছে থাকা হেলিকপ্টার ও ভেহিক্যালস মোতায়েন করেছে। ওই মিটিং সম্পর্কে অবহিত এমন একজন সিনিয়র কূটনীতিক এ কথা বলেছেন। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকরা দেখেছেন নিষ্ঠুরতার আরও তথ্যপ্রমাণ। ছররা গুলি অথবা রাবার বুলেট থেকে তাদের চোখে ক্ষত নিয়ে কমপক্ষে ৩৯ জন মানুষ ভর্তি হয়েছেন সেখানে। চিকিৎসকরা বলেছেন, তাদের মধ্যে কমপক্ষে অর্ধেকই তাদের এক চোখ বা উভয় চোখ হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ, লন্ডনের বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ নাওমি হোসেন বলেন, শিক্ষার্থী, শিশুদের গুলি করা হয়েছে। রাস্তায় খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত, ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত। ওদিকে সরকারের মন্ত্রীরা ও অন্যরা বলছেন, অবকাঠামো এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার জন্য শুধু ব্যবস্থা নিয়েছে রাষ্ট্র। নিহতের ঘটনায় তারা তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে আন্দোলনকারীদের একজন নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তাকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার এজেন্টরা তুলে নিয়ে চোখবেঁধে নির্যাতন করেছে। পরে তাকে একটি সড়কের পাশে ফেলে রাখা হয়। নাহিদ ইসলাম বলেন, যোগাযোগে ব্ল্যাকআউট তুলে না নেয়া এবং আইনপ্রয়োগকারীদেরকে ক্যাম্পাস থেকে তুলে না নেয়া পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা কোনো সমঝোতায় যাবে না।