ডেস্ক রির্পোট:- অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্বিতীয়বারের মতো সচিবালয়ে অফিস করবেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সচিবালয়ের নতুন ভবনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিতব্য এ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সভাপতিত্ব করবেন বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা গত ৫ আগস্ট দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই বলেছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য তারাও তাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আগামী নির্বাচনে কিভাবে দায়িত্ব পালন করবেন সে বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে এ বৈঠকে এটা সহজেই অনুমেয়। প্রশাসনে গুরুত্বর্পূণ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পরিবর্তনের বিষয়েও নির্দেশা দেয়া হতে পারে। এছাড়া সরকার দায়িত্ব নেয়র পর সচিবদের প্রতি ২৫ নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিষয়গুলোর অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হবে। গতকাল বুধবার বিকালে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন-বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সচিব বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা দ্বিতীয়বারের মতো সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সাথে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো কার্যকর করার নির্দেশনা ছাড়াও আরও কিছু নির্দেশনা দিতে পারেন প্রধান উপদেষ্টা। সেগুলো হলো অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে এই মুহূর্তে যেটি করা দরকার, সেটি ঠিক করে বাস্তবায়ন করতে হবে। কাজ করার সময় স্বচ্ছতার পাশাপাশি সংবেদনশীল হওয়ার কথা বলা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, সড়ক পরিবহন ও সেতু, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, খাদ্য, কৃষিসহ ২৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টারা উপস্থিত থাকবেন। প্রশাসনে সচিব,অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব,উপসচিব পদে পদোন্নতি এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠপ্রশাসনের দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসকদের প্রত্যাহার এবং নতুন ডিসি নিয়োগের বিষয়ে বড় ধরনের সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে।
গত বছর ১০ ডিসেম্বর কমিটি প্রধান জাকির আহমেদ খান কমিটির অন্যান্য সদস্যদের উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন পেশ করেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতায় ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে চাকরিতে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার এবং উল্লেখিত সময়কালের মধ্যে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা করে যথাবিহিত সুপারিশ প্রণয়নের জন্য সরকার ১৬ সেপ্টেম্বর সাবেক অর্থ সচিব এবং বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশে সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক জাকির আহমেদ খানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। নির্ধারিত ৯০ দিনের পূর্বেই প্রতিবেদন পেশ করায় কমিটির সদস্যদের প্রধান উপদেষ্টা ধন্যবাদ জানানো হয়।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এক বছরে সচিব ও সিনিয়র সচিব পদের ৯ জনসহ মোট ২৯ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। গত এক বছরে (গত বছরের ৮ আগস্ট থেকে বর্তমান পর্যন্ত) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নিয়ে তৈরি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এক বছরে নিয়মিত ও ভূতাপেক্ষ মিলিয়ে এক হাজার ৫৪৯ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। নানা অনিয়মের অভিযোগে ২৪টি বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, গত বছরের ৮ আগস্ট থেকে বর্তমান পর্যন্ত এক বছরে অতিরিক্ত সচিব পদের ১৯ জন, গ্রেড-১ পদের একজন এবং সচিব-সিনিয়র সচিব পদের ৯ জনসহ সর্বমোট ২৯ জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। এসময়ে উপসচিব পদে ১৪১ জন, যুগ্মসচিব পদে ৪২৪ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৪৯ জন, গ্রেড-১ পদে ২৬ জন এবং সচিব-সিনিয়র সচিব পদে ৪৫ জনসহ মোট ৭৮৫ জন কর্মকর্তাকে নিয়মিত পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে উপসচিব পদে চারজন, যুগ্মসচিব পদে ৭২ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, গ্রেড-১ পদে ৪১ জন এবং সচিব পদে ১১৯ জনসহ সর্বমোট ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে গত এক বছরে উপসচিব পদের ১৬ জন, যুগ্মসচিব পদের ১৫ জন, অতিরিক্ত সচিব পদের ৭৫ জন, গ্রেড-১ পদের ৩৪ জন এবং সচিব-সিনিয়র সচিব পদের ২৪ জনসহ মোট ১৬৪ জন কর্মকর্তা কর্মকাল শেষে স্বাভাবিক অবসরে গেছেন। এক বছরে ২৪টি বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়, ৮টি বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। এছাড়াও ১৬টি বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে। প্রশাসনিক তদন্ত শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম-সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস এবং লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাবেক সহকারী কমিশনার তাপসী তাবাসসুম উর্মীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনে আরও জানিয়েছে, এক বছরে তিনটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন, তিনটি বিধিমালা সংশোধন, একটি বিশেষ বিধিমালা প্রণয়ন এবং ২২টি নিয়োগ বিধিমালা বা প্রবিধানমালা প্রণয়ন/সংশোধনে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৪ সেপ্টেম্বর সচিবসভায় যে ২৫ দফা নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে সচিবদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। ২৫ দফা নির্দেশনা উল্লেখ করে সেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে সম্প্রতি সচিবদের কাছে পত্র পাঠান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ৪ সেপ্টেম্বর প্রথম সচিবসভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে নিজের অধীন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। সব সচিবের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় সচিব সভা। এতে কখনো সরকার প্রধান উপস্থিত থাকেন, আবার কখনো এটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ‘মার্চিং অর্ডার’ অনুসরণ করতে হবে। সৃষ্টিশীল, নাগরিকবান্ধব মানসিকতা নিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার পরিকল্পনা এবং স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ ছাড়া নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়নে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা ও তাঁদের মতামত নেওয়া, বিবেক ও ন্যায়বোধে উজ্জীবিত হয়ে সবাইকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা, জবাবদিহি নিশ্চিত করে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য গৎবাঁধা চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে চিন্তার সংস্কার করে, সৃজনশীল উপায়ে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে সেবা সহজীকরণের মাধ্যমে জনগণের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। সেবাপ্রার্থীদের কেউ যেন ভোগান্তি, হয়রানি কিংবা কোনো কারণে দীর্ঘসূত্রতার শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি সরবরাহ নিশ্চিত করে তা অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষি উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সরকারকে জনবান্ধব সরকারে পরিণত করতে সমবেতভাবে কাজ করতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম যাচাই করে প্রয়োজনে সংস্কার করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও সঞ্চালন যাতে ব্যাহত না হয় সে বিষয়ে তৎপর থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। গ্যাসের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্য সংগ্রহ, মজুদ ও সরবরাহ সন্তোষজনক রাখতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমদানির বিকল্প উৎস বের করতে হবে। ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়মিত তদারকি করতে হবে। শিল্প উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। চিঠিতে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া এসব নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নে সচিবদের একান্ত সহযোগিতা ও উদ্যোগ কামনা করা হয়। একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে সেই বিষয়ে অগ্রগতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানানোর অনুরোধ জানানো হয়। নির্দেশনায় বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আগ্রহ, ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, দেশের স্বার্থে তা সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগাতে হবে। এ রকমভাবে ২৫টি নির্দেশনা উল্লেখ করে সেগুলো বাস্তবায়নে সচিবদের কাছে পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
গত ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টার রাষ্ট্রীয় বাসভবন যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হতো। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংস্কার করার পর এটিকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। এর পর থেকে নিয়মিতভাবে সেখানেই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর গত বছরের ২০ নভেম্বর সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের ১৩ তলায় মন্ত্রিসভা কক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের একটি বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তাই এটা প্রধান উপদেষ্টারও দ্বিতীয়বারের মতো সচিবালয়ে আসা। তবে নতুন ভবনে এটাই প্রথম উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টার রাষ্ট্রীয় বাসভবন যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হত। সরকার পতনের দিন ক্ষতিগ্রস্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংস্কারের পর এটিকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে রূপান্তরের পর থেকে নিয়মিতভাবে সেখানেই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হচ্ছে। সেই হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার দ্বিতীয়বারের মতো সচিবালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন প্রধান উপদেষ্টা।ইনকিলাব