ডেস্ক রির্পো:- মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। আট-দশটা দিনের মতো শিশুরা এসেছিল স্কুলে। হাসি-আনন্দ, খেলা; খুনশুটিময় বন্ধুত্ব। বেজে উঠলো ছুটির ঘণ্টা। ছোট্ট পাখিগুলোর এবার নীড়ে ফেরার পালা। কেউ রয়েছে ক্লাসে, কেউবা বারান্দায়। অনেক শিশুর অপেক্ষা মা-বাবা আসবে নিয়ে যাবে। প্রতিদিনের মতোই স্কুলের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বড় বড় বিমান। ছুটির ঘণ্টা বাজার কয়েক মিনিটের মধ্যেই বদলে গেল চিত্রপট। মেঘের কোলে থাকা একটা যুদ্ধ বিমান হলো দিগ্ভ্রান্ত। উড়ে এসে আঘাত করলো সদ্য ছুটি হওয়া স্কুলে। মুহূর্তেই দাউ দাউ আগুনে গ্রাস করলো চারপাশ। ছুটি হওয়া পাখিগুলো আর ফিরলো না নীড়ে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টি আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি-ই হয়ে গেল চিরদিনের ছুটি। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। উত্তরায় দিয়াবাড়ীতে ক্যাম্পাস। গত সোমবার উচ্ছল শিশুদের দুুরন্তপনায় মেতে ছিল ক্যাম্পাস। দুপুর একটায় স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বাজার কয়েক মিনিটের মাথায় আছড়ে পড়ে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান। এখন পর্যন্ত হারিয়েছে ৩৩টি প্রাণ। ৫০ জন কাতরাচ্ছে হাসপাতালের বিছানায়।
যে পাখিরা আর ফেরেনি: অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদের স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। বিমান দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হলো তার। অসুস্থ থাকায় দু’দিন স্কুলে যেতে পারেনি সপ্তম শ্রেণির মো. আফনান ফাইয়াজ। সোমবার অসুস্থতা নিয়ে স্কুলে গিয়ে আর ফেরা হয়নি ঘরে। আগুনের লেলিহান শিখায় প্রাণ হারায় দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিয়া নাশরাফ নাফি (৯)। তার বোন ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজিয়া তাবাস্সুম নিঝুমও (১৩) মারা যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায়। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ছিল দুই ভাইবোন। শরীরের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় এবি শামীম। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই শেষ হয় তার যাত্রা। ৯৫ শতাংশ দগ্ধ শায়ান ইউসূফের মৃত্যু হয় চিকিৎসাধীন অবস্থায়। তার বাবা-মা দু’জনই মাইলস্টোনের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক। ৮ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যায় বাংলা বিভাগের শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের মেয়ে মেহনাজ আফরিন হুমাইরা। উক্য ছাই মারমা এরিকসন ইংরেজি বিভাগে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। দুর্ঘটনার দিন দাঁড়িয়েছিল ক্লাসের বারান্দায়। আগুনে পুড়ে যায় শরীর। আগুনের দগ্ধ অবস্থায় তার শিক্ষককে বলেছিল, আমার হাতে বাবার নম্বর লিখে দেন। আমার দেহটি যেন শনাক্ত করতে পারে। পুরোপুরি দগ্ধ অবস্থায় বার্ন ইউনিটে নেয়া হয়। সেখানেও শিক্ষক আর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেছিল হাসিমুখে। শুধু বলেছিল, পানির পিপাসা পেয়েছে খুব। কিন্তু সে পানি পান করতে পারেনি। পাশে থাকা তার খালাকে বলেছিল, আমাকে যেতে হবে। আমি আর বাঁচবো না। বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। বাবা আসার পর এরিকসনের মৃত্যু হয়। এক বছরের ব্যবধানে জন্ম হয়েছিল উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থী মাহিদ হাসান আরিয়ান (১১), মো. আশিকুর রহমান উমাইর (১০) ও বোরহান উদ্দিন বাপ্পি (১০)। তাদের সম্পর্ক চাচা-ভাতিজা, বাড়িও পাশাপাশি। একই স্কুলে, যাওয়া-আসা করতো একসঙ্গে। আরিয়ান ওই স্কুলের চতুর্থ, উমাইর ও বাপ্পি ছিল তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। উমাইর ঘটনাস্থলে, জীবিত উদ্ধার হওয়া আরিয়ান ও বাপ্পি বার্ন ইনস্টিটিউটে মারা যায়। তাদের কবরও হয়েছে একই সঙ্গে।
মৃত্যুর তালিকায় রয়েছে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিউল করিম। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় ৯ বছরের ফাতেমা আক্তার। সারিয়া আক্তার ও জুনায়েত হাসান; চাচাতো ভাই-বোন চলে গেছে না ফেরার দেশে। তাদের দাফন হয়েছে একই সঙ্গে। কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল নুসরাত জাহান আনিকা। তার মা টিফিন দিয়ে ফিরছিলেন। খাবার শেষ হওয়ার আগেই বিমান বিধ্বস্ত হয়। প্রাণে বাঁচতে পারেনি তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়মা আক্তার ও সাদ সালাউদ্দিন। আগুনে পুড়ে যাওয়া পাঁচজনের লাশ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। মো. ফারুক হোসেন ও সালমা আক্তার দম্পতির মেয়ে ওকিয়া ফেরদৌস নিধি; মো. বাবুল ও মাজেদা দম্পতির মেয়ে লামিয়া আক্তার সোনিয়া; মো. আব্বাস উদ্দিন ও মোসা. মিনু আক্তার দম্পতির মেয়ে আফসানা আক্তার প্রিয়া; মো. শাহাবুল শেখ ও মিম দম্পতির মেয়ে রাইসা মণি এবং আবদুল কাদির ও উম্মে তামিমা আক্তার দম্পতির মেয়ে মারিয়াম উম্মে আফিয়া। বৃহস্পতিবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় মাহতাব রহমান ও মাহিয়া তাসনিমের। মাহতাব স্কুলের ইংলিশ ভার্সনের সপ্তম এবং মাহিয়া অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। মাহতাবের শরীরে ছিল ৮৫ শতাংশ ও মাহিয়ার ৫০ শতাংশ দগ্ধ। গতকাল বার্ন ইনস্টিটিউটে মৃত্যু হয় আইমান ও মুসাব্বির মাকিন নামে অগ্নিদগ্ধ আরও শিশু দুই শিক্ষার্থীর। আইমানের শরীরের ৪৫ শতাংশ ও মাকিনের শরীরের ৭০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। এদের মধ্যে আইমান চতুর্থ ও মুসাব্বির মাকিন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। শিশুদের পাশাপাশি মৃত্যু হয় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের। তিনিই বিমানটি চালাচ্ছিলেন।
২০২৫ সালের ২১শে জুলাই তিনি প্রশিক্ষণের শেষ ধাপে তার প্রথম একক যাত্রার সময় এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মাহরীন চৌধুরী স্কুলটির শিক্ষক। দুর্ঘটনায় দাউদাউ করে জ্বলে আগুন। চাইলে তিনি নিরাপদে সরে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে শিক্ষার্থীদের সেখান থেকে নিরাপদে সরিয়ে আনেন। একে একে অন্তত ১৮ থেকে ২০ জন শিশুকে আগুনের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিজেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কবলে। না ফেরার দেশে পাড়ি দেন আরেক শিক্ষক ৩৭ বছর বয়সী মাসুকা বেগম। সন্তানকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে মৃত্যু হয় রজনী ইসলামের। তার মেয়ে ঝুম ঝুম ইসলাম পঞ্চম শ্রেণিতে এবং ছেলে রোহান ইসলাম মাইলস্টোনের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী।মানবজমিন