বান্দরবান:- বান্দরবানে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা, খাদ্য, চিকিৎসাসহ সার্বিক সহযোগিতায় আশ্বস্থ হয়ে পাড়ায় ফিরে আসছেন বম জনগোষ্ঠির লোকজন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, পার্বত্য শান্তির পথে এটি একটি মাইলফলক ।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে কেএনএফের যুদ্ধ শুরু হলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল এসব বম পরিবার। তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ফের তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আনতে সক্ষম হলো দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী।
স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ইতোমেধ্য ২৮টি পাড়ার ১২১টি বম পরিবারের ৩২৮ জন সদস্য ফিরে এসেছে। এদের মধ্যে পুরুষ ১৭২ জন, মহিলা ১১৬ জন এবং শিশু আছে ৪০ জন। ফলে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে পাড়াগুলোর অধিবাসীদের জীবনযাপন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার ফারুক পাড়া, শ্যারণ পাড়া, লাইমি পাড়া, গেশীমনি পাড়া, ইডেন পাড়া, পানখিয়াং পাড়া, কানা পাড়া, দার্জিলিং পাড়া, বাকলাই পাড়া, থান্দুইপাড়া, সিমতাংপি পাড়া, প্রাতা পাড়া, খামতাংপাড়া টিওবি, জোরবারং পাড়া, পাইক্ষ্যংপাড়া, গীর্জা পাড়া, বেথেল পাড়া, আর্থাপাড়া, মুলফিপাড়া, মুনলাইপাড়া, পাইলট পাড়া, বাতাতাং পাড়া, হ্যাপিহিল পাড়া, লাইরনপি পাড়া, বগালেক পাড়া, বেথেলহেম পাড়া, ইডেন পাড়া থেকে পালিয়ে যাওয়া বাসিন্দাদের অনেকেই ফিরে এসেছেন। অন্যরাও ফিরে আসছেন বলে জানিয়েছেন পাড়ার লোকজন।
উল্লেখ্য ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল পার্বত্যনিউজের এক রিপোর্টের মাধ্যমে কেএনএফের অস্তিত্ব প্রথম বাংলাদেশের মানুষের সামনে উঠে আসে। বম, পাঙ্খুয়া, লুসাই, খুমী, ম্রো, খিয়াং নামের ছয়টি জাতি গোষ্ঠী মিলে গঠিত হলেও কেএনএফ মূলত বম ডমিনেটেড একটি সংগঠন। শুরুতে জেএসএসের সশস্ত্র সংগঠন জেএলএ বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের জোরালো অবস্থান লক্ষ করা যায়। তবে কিছুদিন পরেই তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংগঠের সম্পৃক্ততার খবর আসে। এর ফলে সেনাবাহিনী এবং র্যাবসহ যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু হয় তাদের বিরুদ্ধে। অভিযানে সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য হতাহত হওয়ার পাশাপাশি কেএনএফের অনেক সদস্য হতাহত এবং গ্রেফতার হয়। একই সময় তাদের আস্থানা থেকে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদও উদ্ধার করে সেনাবাহিনী।
এক পর্যায়ে বান্দরবান জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কেএনএফের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। শান্তি আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় ২০২৪ সালের এপ্রিলের শুরুর দিকে হঠাৎ করেই কেএনএফ ইউটার্ন নেয়। মাত্র ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে থানচি এবং রুমাতে দুটি ব্যাংক লুট করে তারা। এসময় ব্যাংকের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ও গোলাবারুদও লুট করে নিয়ে যায় কেএনএফের সন্ত্রাসীরা। ফলে ভেস্তে যায় শান্তি আলোচনা। সেনাবাহিনী আবারো অভিযানে নামে কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে। এর ফলে সৃষ্ট আতঙ্কে পাড়াগুলো থেকে পালিয়ে যায় বম জনগোষ্ঠির সাধারণ মানুষও।
তবে সেনাবাহিনীর অভিযান যে বম জনগোষ্ঠির সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং এই অভিযান শুধুমাত্র সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সেটি তারা তাদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা, খাদ্য, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন মানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বোঝাতে সক্ষম হয়। এর ফলে ধীরে ধীরে আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং পালিয়ে যাওয়াদের অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন নিজ নিজ পাড়ার বসতবাড়িতে। জানা গেছে, বান্দরবানের বম পাড়াগুলোতে এখনো যারা ফিরে আসেননি তাদের সকলকে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে সকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার ২৬ জুন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি।
প্রত্যাবর্তনকারী পরিবারগুলোর উদ্দেশে জিওসি বলেন, আপনাদের ফিরিয়ে আনা শুধু আমাদের দায়িত্ব নয়; বরং এটি জাতীয় সংহতির প্রতীক। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির পথে একটি মাইলফলক। নিরাপত্তা, পুনর্বাসন, শিক্ষা ও জীবিকার ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনী সবসময় পাশে থাকবে। এরই মাধ্যমে পাহাড়ের অন্যান্য জনগোষ্ঠীও আশার আলো দেখতে পেয়েছে এবং আগ্রহ তৈরি হয়েছে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনে। সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থান স্পষ্ট—পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো ধরনের সশস্ত্র তৎপরতা গ্রহণযোগ্য নয় এবং এ বিষয়ে সেনাবাহিনী সদা সতর্ক থাকবে।
সেনাবাহিনীর পক্ষ হতে জানানো হয়েছে , যারা এখনও ফিরে আসতে পারেননি, তাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী আশাবাদ ব্যক্ত করেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সম্মানজনক সহাবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ ধরনের উদ্যোগ ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে।পার্বত্যনিউজ