রাঙ্গামাটি:- পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বরাবরই বহুমাত্রিক সংকট, বৈচিত্র্য ও দ্বন্দ্বে জর্জরিত। এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ভারসাম্যে যে যতটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে, ততটুকুই দৃষ্টিগোচর হয়েছে রাষ্ট্রব্যবস্থার দৃঢ়তা অথবা দুর্বলতা। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের ভিত্তিকে নরম করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একটি চিহ্নিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী — ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ)।
আজ বৃহস্পতিবার (১২ জুন) ২০২৫ খ্রি. রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার কচুখালী ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন এলাকায় ইউপিডিএফ সহযোগী সংগঠন ‘হিল উইমেন্স ফেডারেশন’-এর উদ্যোগে ‘কল্পনা চাকমা অপহরণ দিবস’ উপলক্ষে যে ‘নারী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ আয়োজন করা হয়েছে, তা নিছক কোনো স্মারক অনুষ্ঠান নয়; বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। কারণ, এই কর্মসূচির মূল স্লোগান ছিল — “সেনা ও বাঙালি পাহাড় থেকে সরাও”। এই স্লোগানের অন্তরালে লুকিয়ে আছে জুমল্যান্ড নামক বিচ্ছিন্নতাবাদী কল্পনার বাস্তবায়নের নীলনকশা।
একটি অপহরণ, বহু মত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনীতি—
১৯৯৬ সালের ১২ জুন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন বাঘাইছড়ি কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমা অপহৃত হন রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা এলাকা থেকে। ঘটনাটি নিয়ে সেই সময়ই শুরু হয় মতানৈক্য, বিতর্ক এবং গুজব-ঘন ঐতিহ্য। একাংশ দাবি করে, সেনাবাহিনীর লে. ফেরদৌস ও তার সহযোগীরা তাকে অপহরণ করেছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থা, গণমাধ্যম ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা স্পষ্ট করেন — কল্পনা চাকমার অপহরণের পেছনে ছিল তৎকালীন জেএসএসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, প্রেমঘটিত সম্পর্ক এবং ভারতমুখী গমন পরিকল্পনা।
এই ‘অপহরণ কাহিনী’কে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জেএসএস ভেঙে সৃষ্ট চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ প্রতি বছর যেমন চেতনার আগুন জ্বালাতে চায়, তেমনি এর আড়ালে চলে সংগঠনের শাখা বিস্তারের তৎপরতা।
‘সেনা ও বাঙালি সরাও’: রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মুখে থুথু—
ইউপিডিএফ প্রশাসনের নাগালে আয়োজিত কর্মসূচিতে দেখা যায়, রাষ্ট্রবিরোধী ব্যানার, উস্কানিমূলক গান, বিতর্কিত নেতৃবৃন্দ এবং এমনকি সরকার-নিযুক্ত জনপ্রতিনিধি উষাতন চাকমাও উপস্থিত ছিলেন। এই উষাতন হলেন, কাউখালী ২নং ফটিকছড়ি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান এবং ইউপিডিএফ এর নব্য সহযোগী অঙ্গসংগঠন ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভাপতি। এক বাঙালি নাগরিকও বক্তৃতা দিয়েছেন এই কর্মসূচিতে — যা স্থানীয় বাঙালি সম্প্রদায়ের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও আরো উপস্থিত ছিলেন, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভানেত্রী নীতি শোভা চাকমা, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদিকা রিতা চাকমা, পিসিপি’র রাঙ্গামাটি সাবেক সভাপতি নিকন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি শাখার সাবেক সম্পাদিকা এবং মামলার ওয়ারেন্ট ভুক্ত আসামী দয়াসোনা চাকমা এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের নেতাকর্মীরা।
কাউখালী উপজেলা একটি বাঙালি অধ্যুষিত জনপদ। ২০০১ সালের পর এই অঞ্চলে ইউপিডিএফ সেনা ও বাঙালি বিরোধী কোনো বড় কর্মসূচির সাহস দেখাতে পারেনি। কিন্তু হঠাৎ করে প্রশাসনের নীরবতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঢিলেঢালাভাব এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের সুযোগে তারা মাত্র ৫০০ গজের মধ্যে, অর্থাৎ ইউএনও অফিস, থানা ও ক্যাম্পের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে এমন রাষ্ট্রবিরোধী কর্মসূচি পালন করলো — এটি কেবল প্রশাসনের ব্যর্থতা নয়, বরং আত্মসমর্পণের প্রমাণ।
নারী অধিকার না, রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা—
এই তথাকথিত ‘নারী সমাবেশ’ আদতে নারীর নিরাপত্তা বা অধিকার নিয়ে নয় — বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের এক ছলনামাত্র। স্থানীয় সূত্র জানায়, ইউপিডিএফ বিগত দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন উপজাতি পরিবারে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে নারী সদস্যদের এই সমাবেশে অংশগ্রহণে বাধ্য করেছে। অনেকে বাধ্য হয়ে উপস্থিত হলেও, বেশিরভাগ ছিলেন সন্ত্রস্ত এবং অপারগ।
এখানে নারী সমাবেশ ছিল এক প্রাচীন প্রপাগান্ডার আধুনিক রূপায়ণ — যে কৌশলে নারীর মুখে তুলে দেওয়া হয় অস্ত্রধারীর দাবিপত্র।
রাষ্ট্র কী করছে? নাকি দেখছে কেবল?
এই প্রশ্ন এখন কাউখালীর প্রতিটি বাঙালি পরিবারের মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্রশাসনের চোখের সামনেই ইউপিডিএফ তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টায় রত, আর প্রশাসন নিরব দর্শক। এই নিরবতা যেমন ক্ষোভের জন্ম দেয়, তেমনি রাষ্ট্রের প্রতি আস্থার অবক্ষয় ঘটায়।
বাঙালিদের একাংশ সরাসরি প্রশাসনের সমালোচনা করে বলেছে — “যেখানে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী দয়াসোনা চাকমা প্রকাশ্যে বক্তব্য দেয়, যেখানে সরকারী জনপ্রতিনিধি উপস্থিত থাকে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মসূচিতে, সেখানে আমরা নিরাপত্তা কোথায় পাব?” ইউপিডিএফ কর্মসূচী চলাকালীন সময় বাঙালিদের একটি অংশ এবং উগ্র পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ মুখামুখি অবস্থানে ছিল৷ বড় ধরনের জাতিগত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হওয়ার উপক্রম সৃষ্টি হয়েছিল৷ ভাগ্য সহায়ক ছিল বিধায়ী অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি৷ স্থানীয় বাঙালিরা প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন।
কাউখালী কি পরিণত হবে ইউপিডিএফের ঘাঁটি হিসেবে?
এই প্রশ্ন নিছক জল্পনা নয়। বরং ইউপিডিএফের সাম্প্রতিক কার্যক্রম দেখে এ আশঙ্কা দিনে দিনে বাস্তব রূপ নিচ্ছে। অফিস খোলা, নারী সদস্য সংগ্রহ, সংগঠনের সম্প্রসারণ, ভয়ভীতি প্রদর্শন — এসবই ইঙ্গিত দেয় যে, ইউপিডিএফ কাউখালীতে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে চায়।
এই অঞ্চলের নিরীহ উপজাতিদের বিভ্রান্ত করে তারা ‘সেনা ও বাঙালি’কে দোষারোপ করার মাধ্যমে বিভাজনের রাজনীতি করছে। একদিকে বাঙালিদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরি — এটাই ইউপিডিএফের সুপরিকল্পিত যুদ্ধ।
রাষ্ট্র বিরোধিতার শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে এখনই—
পাহাড় নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা জানে, একটি সামান্য স্লোগান দিয়ে বহু জাতিগত উত্তেজনা সৃষ্টি করা যায়। “সেনা ও বাঙালি সরাও” — এই স্লোগান ঠিক তেমনই। এটি নিছক বাক্য নয়, বরং একটি সংঘাতের বীজ। যদি রাষ্ট্র, প্রশাসন ও জনগণ এখনই এই বীজ উপড়ে না ফেলে, তাহলে আগামী দিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম আবারো অস্থিরতা, রক্তপাত ও বিচ্ছিন্নতাবাদে নিমজ্জিত হবে।
সুতরাং, এখনই প্রয়োজন কার্যকর ব্যবস্থা— রাষ্ট্রবিরোধী কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক শুদ্ধি অভিযান, এবং পাহাড়ে বসবাসরত সকল জাতিসত্তার মধ্যে সম্প্রীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বাস্তবায়ন। রাষ্ট্রের সংবিধান এক ও অখণ্ড — তার সীমানা এবং অস্তিত্ব রক্ষাই আজ সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য।