কেএনএফ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০২৫
  • ৮৪ দেখা হয়েছে

# ২৪ দিনে জব্দ ৪৭ হাজার ‘ইউনিফর্ম’
# দুই গার্মেন্টস মালিকসহ গ্রেপ্তার পাঁচ
# জিজ্ঞাসাবাদে মিলছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

ডেস্ক রিপোট:- চট্টগ্রাম শহরে নিষিদ্ধঘোষিত সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) পোশাক জব্দের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। গত ২৫ দিনে (৩ থেকে ২৭ মে) নগরের দুটি পোশাক কারখানা, গুদাম ও একটি ভবন থেকে তিনটি পৃথক অভিযানে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব অভিযানে কেএনএফের ৪৭ হাজার ৮৫টি পোশাক জব্দের এবং ৩১৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে কাপড় (কেএনএফের পোশাকের) জব্দ করেছে পুলিশ।

সর্বশেষ গত ২৭ মে সন্ধ্যায় নগরের পাহাড়তলী থানার ডিটি রোডের সিকান্দর ভিলায় নুর ফ্যাশন অ্যান্ড গার্মেন্টসে অভিযান চালিয়ে কেএনএফের ১২ হাজার ৫০০ পিস পোশাক জব্দ করে পুলিশ।

কারখানা-মালিক মতিউর রহমানকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মতিউর লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানার ব্যাংকান্দা গ্রামের মৃত আজিজার রহমানের ছেলে। গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছে। গত ৩০ মে পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউর রহমানকে পাঁচ দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।

জিজ্ঞাসাবাদে মতিউর রহমান পুলিশকে বলেছেন, মো. শাহেদ নামের এক ব্যক্তি তার ব্যবসায়িক পার্টনার। দুজনে মিলে ৫০ লাখ টাকার চুক্তিতে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন কেএনএফের পোশাক নিজেদের কারখানায় প্রস্তুত করছেন।

গত এপ্রিল মাসে মংহ্লাসিন মারমা (বায়ার) ও বায়েজিদ থানার রিংভো গার্মেন্টসের মালিক ৫৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান কেএনএফের পোশাক তৈরির জন্য গোপনে কাপড়, সুতা, জিপার, বেলকু, লেবেল ও বাটন দিয়ে যান।

কেএনএফের পোশাক জব্দের বিষয়টি প্রথমে উন্মোচিত হয় গত ২ মে। ওইদিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গোপন সংবাদ পেয়ে নগরের পশ্চিম শহীদ নগর তৈয়বিয়া হাউজিং সোসাইটির জনৈক জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন ভবনের চারতলার ১ নম্বর কক্ষ থেকে মো. সুরুজ্জামানকে (৪২) গ্রেপ্তার করা হয়।

সেদিন নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় পুলিশ সুরুজ্জামানের হেফাজত থেকে ৩১৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে কেএনএফের পোশাক তৈরির থান কাপড় (কেএনএফ সিলযুক্ত) জব্দ করা হয়।

সুরুজ্জামান মিয়া টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর থানার চৌকা হাদিয়া ফকির বাড়ির মৃত আবুল কাশেমের ছেলে। ৩ মে সুরুজ্জামানকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেয়। রিমান্ড শেষে ১৩ মে তাকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। সেদিনই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন মো. সুরুজ্জামান। কেএনএফের পোশাক জব্দের ঘটনা চট্টগ্রাম নগর পুলিশের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও, চট্টগ্রামে হঠাৎ কেএনএফের তৎপরতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।

পোশাক তৈরির জন্য কেএনএফ চট্টগ্রাম শহরকে কেন বেছে নিল; তারা কেন পাবর্ত্য এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে সাংগঠনিক শক্তি ও লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়াতে চায় সে প্রশ্নও উঠেছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কেএনএফ শুধু পাহাড়ে নয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি শহরাঞ্চলেও সরবরাহ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তারা অর্থ, অস্ত্র ও পোশাক জোগাড় করতে চায়। শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা নয়, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই দুর্বল করতে চাইছে কেএনএফ।’

কেএনএফের উত্থান ও চট্টগ্রাম শহরে তাদের ইউনিফর্ম তৈরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। গত এক মাসে কেএনএফের ১ হাজার ৯৭৯ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃতদের সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে। গত ২৬ মে সেনাসদরে আয়োজিত বিশেষ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানানো হয়।

গত ২৬ মে রাতে বায়েজিদ থানার পুলিশ নগরের নয়াহাট এলাকার একটি গুদাম থেকে ১১ হাজার ৭৮৫ পিস ইউনিফর্ম জব্দ করে। এর আগে গত ১৭ মে রাতে নয়াহাটের ‘রিংভো অ্যাপারেলস’ কারখানা থেকে ২০ হাজার ৩০০টি ইউনিফর্ম জব্দ করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় কারখানার মালিক সাহেদুল ইসলাম, মো. গোলাম আজম ও নিয়াজ হায়দারকে। আজম ও নিয়াজ পোশাক তৈরির ‘অর্ডার’ এনেছিলেন। সাহেদুল চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার খাগড়িয়া-আমিরখিলের হাবিবুর রহমানের ছেলে, মো. গোলাম আজমের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে। নিয়াজের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়। তিনজনকেই দুদিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।

পুলিশের নথি থেকে জানা গেছে, কেএনএফের পোশাক সরবরাহের নির্দেশ এসেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটির সদস্য মংহ্লাসিন মারমা ওরফে ‘মং’-এর কাছ থেকে। প্রায় ২ কোটি টাকার বিনিময়ে কাজটি হয়েছিল বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।

চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী ও বায়েজিদ বোস্তামী থানায় পৃথক তিনটি অভিযানে কেএনএফের প্রায় ৫০ হাজার পোশাক জব্দ করা হলেও এ বিষয়ে পুলিশ গণমাধ্যমের কাছে কিছু স্বীকার না করায় রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের তরফ থেকে এ ব্যাপারে চুপ থাকার নীতি নেওয়া হলেও পরে তথ্য ফাঁস হয়ে যায়।

জানা গেছে, বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলায় সক্রিয় কেএনএফ গত এক বছরে একাধিকবার সেনাবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা এবং জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার সঙ্গে যৌথ ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনার অভিযোগ আছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, সম্প্রতি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কেএনএফের দূরত্ব তৈরি হলেও নতুনভাবে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ও লজিস্টিক সক্ষমতা গড়ে তুলছে তারা। তারা চট্টগ্রামের মতো বাণিজ্যিক শহরকে তাদের ‘সাপ্লাই চেইনের’ অংশ বানানোর চেষ্টা করছে।

২০২২ সালে পার্বত্য এলাকায় ‘জঙ্গিবিরোধী’ একটি সমন্বিত অভিযান চালিয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘কেএনএফের শক্তি ও সমর্থন তেমন আছে বলে মনে হয় না।’

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘তবে আমার মনে হয় তাদের যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় তারা একটু বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পরে জঙ্গি ইস্যুটি সামনে আসার পর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে।’ দেশরূপান্তর

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions