ডেস্ক রির্পোট:-আসামি বিদেশে, কিন্তু দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে দেশে! আগেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন—এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও ক্রমাগতভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), তদন্ত সংস্থা সিআইডি এবং পুলিশও এমন নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে হরহামেশাই আবেদন করছে। আদালত সেগুলো আমলে নিয়ে নিষেধাজ্ঞাও দিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতে আবেদন করলে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই এমন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া। আমরা অনেক ক্ষেত্রে দেখি সংশ্লিষ্ট আসামি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন; কিন্তু তারপরও আদালত থেকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তার কারণ হচ্ছে, সরকারি কোনো সংস্থা থেকে আদালতে কোনো তথ্যপ্রমাণ দেওয়া হয় না যে ওই আসামি বিদেশে আছেন, না দেশে আছেন। সেটা নিশ্চিত হওয়ারও উপায় থাকে না। তাই আদালত আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে।’
পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর তৎপরতা শুরু করে দুদক। সরকারে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শুরু হয় সিরিজ অনুসন্ধান। গত ১৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে চার্জশিটও দিয়েছে দুদক। গতকাল মঙ্গলবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেন গালিব। দুদকের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আরও আছেন লন্ডনে থাকা ব্রিটিশ এমপি ও শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, আগে থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে ভারতে অবস্থান করা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, আমেরিকায় থাকা হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও রেহানাপুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি।
শুধু তারাই নয়, এর আগে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি ও তাদের ঘনিষ্ঠ আমলা-দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর দুদকের তৎপরতা দেখা যায়। অন্তত ১০০ জন ভিআইপি দেশ ছাড়ার পর তাদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উষ্মা বা কৌতুকও তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, ‘বিদেশে থাকা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুদক দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আবেদন করা মাত্রই যাচাই-বাছাই ছাড়াই আদালত থেকে দুদকের চাহিদা অনুযায়ী আদেশ দেওয়া হচ্ছে। যা বলা যায় ‘চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে’ প্রবাদের মতো।
গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ভারতে চলে যান তার সামরিক উপদেষ্ট তারিক আহমেদ সিদ্দিক। তিনি চলে যাওয়ার পর ৫ মাস পর গত ২৮ জানুয়ারি তারিক সিদ্দিকীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন। তার দেশত্যাগ ঠেকাতে ইমিগ্রেশন পুলিশ ও পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করেন।
একইভাবে গত বছরের ৭ অক্টোবর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। সাবেক এই মন্ত্রী যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত ৬ মার্চ দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী-দুই কন্যাসহ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। দুদকের উপপরিচালক মোজাম্মিল হক আবেদনে বলেন, ‘খায়রুজ্জামান লিটন এবং ছয়টি সংসদীয় আসনের সাবেক আট সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আত্মসাৎ করে আত্মগোপনে যাওয়ার অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে। এজন্য তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।’ অর্থাৎ দেশ ছাড়ার পরই তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে দুদক।
গত ৪ মার্চ দুদকের আবেদনে আলোচিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের ১১ ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। বিভিন্ন সূত্র বলছে, তিনি অনেক আগে থেকেই সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। এ ছাড়া বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর গত ১৪ জানুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চায় দুদক। আদালত তা মঞ্জুর করেন। একইভাবে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদেরও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তারা দুজনই বিদেশে অবস্থান করছেন।
এদিকে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ভারতে অবস্থান করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাকে আজমিরসহ বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, তার স্ত্রী সালমা ওসমান, ছেলে ইমতিনান ওসমান ও মেয়ে লাবিবা জোহার দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা চায় দুদক। আদালত তা মঞ্জুর করেন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দুদকের আবেদনে ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী ও তার স্ত্রী তারিন হোসেনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। তবে নিষেজ্ঞার আগে থেকেই সাবেক এমপি নিক্সন চৌধুরী দেশের বাইরে অবস্থান করার বিষয়ে জানা গেছে।
এ ছাড়া গত ২৭ আগস্ট দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এবং ডিবি পুলিশের প্রধান হারুন উর রশীদ ও তার স্ত্রী শিরিন আক্তারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তবে ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, হারুন বর্তমানে আমেরিকায় আছেন।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শেয়ার বাজার কারসাজি ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে এনআরবিসি ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তিনিও দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে—এমন অন্তত ১০০ জন দেশের বাইরে চলে গেছেন। তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফের নাম রয়েছে। হাছান মাহমুদ বেলজিয়াম ও মাহবুবউল-আলম হানিফ কানাডায় অবস্থান করছেন। এ ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আবুল হাসান মাহমুদ আলী, অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, আশরাফ আলী খান খসরু, আব্দুর রহমান, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মুজিবুল হক মুজিব, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, এ কে এম এ আবুল মোমেন, শাহরিয়ার আলম, মোতাহার হোসেন, জাহিদ আহসান রাসেল, কাজী কেরামত আলী, মির্জা আজম, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম, শেখ সারহা নাসের তন্ময়, সাবেক এমপি কাজী নাবিল আহমেদ, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ অনেক পুলিশ ও আমলা ভারত, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে চলে গেছেন। পুলিশের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা ও আমলারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলে গেছেন।
শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশ ছাড়ার নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বিষয়টি এড়িয়ে যান।
শেখ হাসিনাসহ ভিআইপি আসামিরা বিদেশে চলে যাওয়ার পর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
সাধারণ প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুদক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। সরকারের কোনো সংস্থা দুদককে তথ্য দেয় না যে আসামিরা বিদেশে আছে। তাই আমরা ধরেই নিই সংশ্লিষ্ট আসামি দেশেই আত্মগোপন করে আছে। তাই তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এরপর গেজেট নোটিফিকেশন। কেউ বিদেশ থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেলে তদন্ত সংস্থা পুলিশের মাধ্যমে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন জানিয়ে থাকে। কালবেলা