এবার পাহাড়েও অস্থিরতা তৈরির ষড়যন্ত্র ভারতের,১০টি পয়েন্ট ভাবনাকেন্দ্রর নামে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে প্রতিষ্ঠা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ১০৭ দেখা হয়েছে

ডেস্করির্পোট:- দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যস্ততার সুযোগে ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। আর এ কাজে প্রত্যক্ষভাবে মদত দিচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। খাগড়াছড়ি আর রাঙ্গামাটির সীমান্ত এলাকাগুলোর মধ্যে অন্তত ১০টি পয়েন্ট পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি পয়েন্টে ভাবনাকেন্দ্র কিংবা ধর্মীয় উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করেছে তারা।

এসব ভাবনাকেন্দ্রের আড়ালে চলছে সন্ত্রাসী তৎপরতা। নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে এসব এলাকায় অভিযান চালালেই করা হয় অপপ্রচার। শতাধিক ফেসবুক পেজ ও অ্যাকাউন্ট এবং বিভিন্ন নামে-বেনামে কমপক্ষে ১০টি ওয়েবপোর্টাল ব্যবহার করে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। যার বেশির ভাগই চলছে সীমান্তের ওপার থেকে ভারতের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে।

সচেতনমহল বলছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অপতৎপরতা চলছে দেশ স্বাধীনের পর থেকেই। পাহাড়ের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে অস্ত্র জোগানোর পাশাপাশি সরাসরি আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে। শুরু থেকেই এসব সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে মোকাবিলা করে আসছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অব্যাহত অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা। কিন্তু তাদের পুনর্গঠিত করার মিশন নেয় ভারত।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে কথিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির নামে পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনীর আধিপত্য কমিয়ে আনার ষড়যন্ত্র সফলভাবে বাস্তবায়ন করে দেশটি। কথিত ওই শান্তিচুক্তির কারণে দুর্গম এলাকাগুলো থেকে ২৪৬টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়। পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিদের বঞ্চিত করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে।

সেনা তৎপরতা কমে আসার সুযোগে ফের সংগঠিত হয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। আগে একটি সশস্ত্র গ্রুপ থাকলেও এখন ৬টি সশস্ত্র সংগঠনের অপতৎপরতা রয়েছে পাহাড়ে, যাদের মূল কাজ পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দুর্বল করা। বড় এই কাজের অর্থের জোগান আসে চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে। সবশেষ নানিয়ার চরসহ দুর্গম এলাকাগুলোর ২২টি মোবাইল টাওয়ারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় সন্ত্রাসীরা। মোটা অঙ্কের চাঁদা না দিলে মোবাইল কোম্পানিগুলোকে নেটওয়ার্ক চালাতে দেবে না বলে হুমকি দেওয়া হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পার্বত্য এলাকায় জেএসএস, জেএসএস সংস্কার, ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, কুকি চীন ও এমএনপি নামের ছয় সংগঠনের অস্তিত্ব থাকলেও সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ছড়ায় জেএসএস আর ইউপিডিএফ। পার্বত্য এলাকায় উৎপাদিত একটি আনারস বিক্রি করতে হলেও সংগঠন দুটিকে দিতে হয় চাঁদা। এসব সংগঠনের টোকেন ছাড়া কোনো বাজারে ব্যবসা করতে পারেন না ব্যবসায়ীরা।

জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সীমান্ত এলাকাগুলোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়তে শুরু করেছে। রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর, লংগদু, বরকল, মাইনিমুখবাজার, খাগড়াছড়ির দিঘীনালা, পানছড়ি, লোগাং, সাজেকের মাচালং, বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি, আলীকদম সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র তৎপরতা থাকলেও সবচেয়ে বেশি সক্রিয় রয়েছে রাঙ্গামাটি, লংগদু, বরকল উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা বন্দুকভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে। এলাকাটি বর্তমানে জেএসএস ও ইউপিডিএফের কথিত সামরিক শাখার সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শান্তিচুক্তির আগে সেখানে একটি সেনাক্যাম্প ছিল। চুক্তির ধারা মানতে গিয়ে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিলে এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নেয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। দুর্গম এলাকাটিতে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি সেখানে তৈরি করা হয় একাধিক ধর্মীয় উপাসনালয় বা ভাবনাকেন্দ্র। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাম্প্রতি বন্দুকভাঙ্গার যমচুগ এলাকায় অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। অভিযানে এক সন্ত্রাসী নিহত হওয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের চালান উদ্ধার করা হয়।

কিন্তু অভিযানের পর থেকেই ভাবনাকেন্দ্রে সেনা অভিযান বলে ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে এনে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। বিভিন্ন ধরনের ছবি এডিট করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সাইবার দুনিয়ায়। এসব দেখিয়ে দেশ-বিদেশে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকার কিছু এনজিও ব্যক্তিত্ব ও কথিত সুশীলকেও কাজে লাগানো হচ্ছে এসব অপপ্রচারকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কাছেও স্মারকলিপির নামে নালিশ করেছে তারা।

তদন্তে দেখা গেছে, কমপক্ষে ১০টি ওয়েবপোর্টাল, ৩টি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, একটি টেলিগ্রাম গ্রুপ ও শতাধিক ফেসবুক পেজ ও অ্যাকাউন্ট থেকে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। যার সবকয়টিই পরিচালিত হচ্ছে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম এলাকা থেকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির সীমান্ত এলাকার প্রতিটি পয়েন্টে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের গ্রাম স্থাপন করার পাশাপাশি একাধিক ভাবনাকেন্দ্রও প্রতিষ্ঠিত করেছে তারা। তবে এসব উপাসনালয়ে সাধারণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। মূলত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেই ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে আনতে এই ভাবনাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

অভিযান সমাপ্ত করে চলতি মাসের শুরুতে যমচুগ এলাকা ত্যাগ করে সেনাবাহিনী। সঙ্গে সঙ্গে কথিত ভাবনাকেন্দ্রের দখল নিতে জেএসএস ও ইউপিডিএফের সশস্ত্র সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়, যা এখনো চলমান। যমচুগের এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির সীমান্ত এলাকাগুলোতে। স্থানীয় জনসাধারণ জীবন বাঁচাতে বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাশের এলাকায়। তাদের দাবি, ভারতে অবস্থান করা জেএসএস ও ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা মাঝেমধ্যেই সীমান্ত পেরিয়ে এসে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।

অপতৎপরতা আ.লীগের পতনের পর থেকেই

গত ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের ওপর হামলা করেন ইউপিডিএফের সদস্যরা। এ ঘটনাকে পুঁজি করে পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি শহরে মিছিল থেকে বিনা উসকানিতে হামলা শুরু করে দুর্গম এলাকা থেকে আসা কয়েক শ অপরিচিত নারী-পুরুষ। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে শহরে। কিন্তু সরকারের পদক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায় সেদিনই।

পরবর্তী সময়ে কৌশল বদলে এবার সরাসরি নিরাপত্তা বাহিনীকে বিতর্কিত করার মিশন নিয়ে মাঠে নামে ভারত। আর এ পর্যায়ে কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিয়েছে অপপ্রচার, সাইবার প্রপাগান্ডা আর হেইট ক্যাম্পেইনকে। দুষ্কৃতকারী দমনে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচালিত যে কোনো অভিযানকে ওই স্থানের ধর্মীয় উপাসনালয়, কিয়াংঘর কিংবা ভাবনাকেন্দ্র অবমাননার অভিযোগ তুলে স্থানীয় ধর্মভীরু জনসাধারণের মনে বিদ্বেষ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।

ভারত থেকে ইউপিডিএফের অস্ত্রের চালান জব্দ

গত ১৫ জানুয়ারি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামে বাংলাদেশে পাচারের জন্য প্রস্তুত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করে মিজোরাম পুলিশ। এ ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফের সরাসরি সম্পৃক্ততা পায় বলে জানায় দেশটির রাজ্য পুলিশ। অভিযানে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ছয়টি একে-৪৭ রাইফেল, ১০ হাজার ৫০ রাউন্ড গোলাবারুদ ও ১৩টি ম্যাগজিন। অভিযানে পাঁচজন সন্দেহভাজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। মূলত ভারতের সেভেন সিস্টারখ্যাত রাজ্যগুলোতে স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর অস্ত্র ভেবে চালানটি জব্দ করা হয়। কিন্তু জব্দ করার পর জানা যায়, বড় এ অস্ত্রের চালানটির গন্তব্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বক্তব্য

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শহীদ উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ধর্মীয় স্পর্শকাতর ইস্যুকে সামনে আনা ভারতের পুরোনো পরিকল্পনার অংশ। বাংলাদেশে ভারত সমর্থিত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তারাই মূলত ধর্মীয় কার্ড খেলা শুরু করে। প্রথমে সমতলে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা করে। সেখানে সুবিধা করতে না পেরে এখন তারা পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ওপর ভর করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পাহাড়ের সহজ-সরল মানুষদের বিভ্রান্ত করতে এ ইস্যুকে সামনে আনা হচ্ছে। শুরুতেই এ বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলে সরকারকে পস্তাতে হবে।

শহীদ উল্লাহ চৌধুরী আরো বলেন, শান্তিচুক্তি অনুযায়ী নতুন করে সেনাক্যাম্প বাড়ানোর ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বর্তমান ক্যাম্পগুলোতে সেনাসদস্য বাড়ানো উচিত সরকারের। একই সঙ্গে ড্রোনসহ আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত করার পাশাপাশি অন্য বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো উচিত পার্বত্য এলাকায়।আমারদেশ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions