ডেস্ক রির্পোট:- গত বছরের জুলাই ও আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ছাত্র আন্দোলন মোকাবেলায় অভিযান পরিচালনায় সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ, এমনকি হত্যা করেও আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা ছিল।
গতকাল বুধবার জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে প্রকাশিত সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
এর আগে এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধান মিশনের নজির ছিল।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটিই প্রথম। প্রবল আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। সেদিনই শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
খোদ হাসিনাই হত্যার নির্দেশদাতাপ্রধান উপদেষ্টার অনুরোধে জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধান মিশন গত বছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে।
সরকারি-বেসরকারি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর গতকাল বলেছে, এই বিক্ষোভ চলাকালে এক হাজার চার শর মতো মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারে। তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহৃত প্রাণঘাতী অস্ত্র, সামরিক রাইফেল ও শটগানের গুলিতে নিহত হন। গুরুতর আহত হয়েছেন আরো কয়েক হাজার।
জীবন বদলে দেওয়ার মতো গুরুতর আঘাতের শিকার হয়েছেন তাঁরা। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে দেওয়া পুলিশ ও র্যাবের তথ্য অনুসারে, ১১ হাজার ৭০০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হতাহতের পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ শিশু। পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীও শিশুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। শিশুরা হত্যা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পঙ্গু, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অমানবিক পরিস্থিতিতে আটক, নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের বাজে আচরণের শিকার হয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সাবেক সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংস গোষ্ঠীগুলো গত বছরের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য এবং অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে, প্রতিবেদনে একটি সরকারি নীতি উঠে এসেছে, যা সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারী এবং সমর্থকদের আক্রমণ ও সহিংসভাবে দমন করার নির্দেশ দেয়। এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো উদ্বেগ উত্থাপনকারী এবং জরুরি ভিত্তিতে ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত মৃত্যুর তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে এক হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে এবং হাজার হাজার মানুষ আহত। তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, তাদের ৪৪ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
শেখ হাসিনাসহ তাঁর দল ও সরকার এবং বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সম্পৃক্ততার তথ্য রয়েছে জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে। ১৮ জুলাই বিটিভি ভবনে হামলার পর থেকেই বিজিবিকে ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কোর কমিটির বৈঠকে অন্য বাহিনীগুলোর প্রধানদের সামনেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজিবি অধিনায়ককে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া এক কর্মকর্তা জাতিসংঘকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, পরদিন ১৯ জুলাই বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিক্ষোভ দমনে বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দেন। তিনি বিশেষ করে যারা সমস্যা করছে, তাদের এবং তাদের নেতাদের গ্রেপ্তার, হত্যা ও মরদেহ লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার ওই সাক্ষ্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের সংগতি আছে। ওবায়দুল কাদের ‘শুট অ্যাট সাইট’-এর (দেখামাত্র গুলি করার) নির্দেশ দিয়েছিলেন।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলন মোকাবেলায় তৎকালীন সরকারের তৎপরতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিক্ষোভ পর্যবেক্ষণ ও মোকাবেলায় বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়সাধন, তাদের মোতায়েনের নির্দেশনা ও অভিযানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘কোর কমিটি’ নামে পরিচিত একটি সংস্থার নিয়মিত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বিক্ষোভের সময় বেশ কয়েকটি সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে ওই বৈঠক হতো।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক, বিজিবি, র্যাব এবং আনসার/ভিডিপির মহাপরিচালক, গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং প্রায়ই এনটিএমসি), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এবং ২০ জুলাই থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র জেনারেল। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বেশ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা নিয়মিত ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে এবং টেলিফোনে আলোচনা এবং তাঁদের কার্যক্রম সরাসরি তদারকি এবং পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার এবং জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরকে দেওয়া ফোনালাপের তালিকা এ বিষয়টি নিশ্চিত করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভে প্রথম দিকের অগ্রভাগে থাকার কারণে নারী ও কন্যাশিশুরা নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলার শিকার হয়েছে। তারা বিশেষভাবে যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। লিঙ্গভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা, ধর্ষণের হুমকি এবং কিছু নথিভুক্ত ঘটনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর প্রতিশোধমূলক সহিংসতা হিসেবে যৌন সহিংসতা এবং ধর্ষণের হুমকি সম্পর্কিত অভিযোগ পেয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা এবং বাংলাদেশে যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কিত তথ্য কম আসে। এমন প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর মনে করে, যৌন সহিংসতার সম্পূর্ণ তথ্য নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিপূর্ণ সহায়তার জন্য আগামী দিনে এর গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরনো আইন ও নীতি, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন কাঠামো এবং আইনের শাসনের অবক্ষয়ের কারণে প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে বল প্রয়োগ করা হয়েছে। পুলিশের সামরিকীকরণ, নিরাপত্তা ও বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি প্রদান করা হয়েছে। বিগত আওয়ামী সরকার শান্তিপূর্ণ নাগরিক ও রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করার জন্য ব্যাপকভিত্তিক আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এমন নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির কারণে বিরোধীরাও সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং প্রতিবাদ সহিংসতার দিকে ধাবিত হয়।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া সরকারবিরোধী আন্দোলন ঘিরে যে সহিংসতা হয়েছে, এতে ইন্ধন ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থকদের। সরকারকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িয়েছে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সামরিক বাহিনীকেও মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনে যুক্ত হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা কার্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে—এমন আশঙ্কার কথা জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। এটিই পরবর্তী সময়ে আন্দোলনকারীদের ওপর সেনাবাহিনীর গুলি না চালানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে জানা যায়।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর প্রতিশোধমূলক সহিংসতা শুরু হয়। ক্ষুব্ধ জনগণ বেশ কিছু থানায় হামলা চালায় ও পুড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৪৫০টি থানা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে, পুলিশ কর্মকর্তারা পালিয়ে গেছেন বা তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের সরে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। কিছু সদস্য হামলার শিকার বা নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘ বলেছে, গত বছর জুলাইয়ে বাংলাদেশে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনকারী উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত থেকে। এর পেছনে ছিল ধ্বংসাত্মক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি এবং প্রশাসন থেকে সৃষ্ট বিস্তৃত ক্ষোভ, যা অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি করেছিল।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্ষমতায় থাকার জন্য সাবেক সরকার ক্রমাগত সহিংস পন্থা ব্যবহার করে এই বিক্ষোভগুলো দমনে পদ্ধতিগতভাবে চেষ্টা করেছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ মোকাবেলায় জড়িত সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং অন্য অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বর্ণনা করেছে, কিভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মকর্তারা একাধিক বৃহৎ আকারের অভিযানের নির্দেশনা দেন ও তদারকি করেন। নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করেছিল বা নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছিল, তা-ও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এতে দেখা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এবং অবৈধভাবে বিক্ষোভকারীদের হত্যা বা পঙ্গু করার সঙ্গে জড়িত ছিল। এর মধ্যে এমন ঘটনাও ছিল, যেখানে লোকদের খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে অন্যদের মধ্যে আবু সাঈদের বিশেষ ঘটনাটি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের সময় পুলিশকে উদ্দেশ্য করে তাঁর দুই বাহু ছড়িয়ে ‘আমাকে গুলি করুন’ বলে চিৎকার করার সময়ের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল। ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র এবং ভূ-অবস্থান প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তদন্তকারীরা তাঁর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি কিভাবে ঘটেছিল, তা সাক্ষ্য-প্রমাণের জন্য পুনর্নির্মাণ করেন।
একটি ফরেনসিক বিশ্লেষণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে তার আঘাতগুলো ছিল প্রায় ১৪ মিটার দূর থেকে, ধাতব গুলিবোঝাই শটগান দিয়ে। সেগুলো কমপক্ষে দুবার গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবু সাঈদ পুলিশের ইচ্ছাকৃত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের হত্যা ও পঙ্গু করেছে। এ ছাড়া তাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অমানবিক অবস্থায় আটক এবং অত্যাচার করেছে। নথিভুক্ত মৃত্যুর ঘটনাগুলোর একটি এমন ছিল, যেখানে ধানমণ্ডিতে একজন ১২ বছর বয়সী বিক্ষোভকারী প্রায় ২০০টি ধাতব গুলি ছোড়ার কারণে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণে মারা যায়। এ ছাড়া নিহতদের মধ্যে ছিল খুব ছোট শিশু, যাদের তাদের মা-বাবা বিক্ষোভে নিয়ে গিয়েছিলেন অথবা তারা পথচারী হিসেবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে এমন একটি ঘটনা রয়েছে, যেখানে একজন ছয় বছর বয়সী বালিকাকে তার বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে একটি বিক্ষোভের সহিংস সংঘর্ষ প্রত্যক্ষ করার সময় মাথায় গুলি করা হয়েছিল।
গত বছরের ৫ আগস্ট বিক্ষোভের শেষ এবং সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিনগুলোর অন্যতম। আজমপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ১২ বছর বয়সী একটি ছেলে সেদিনের কথা স্মরণ করে জানায়, পুলিশ সব জায়গায় বৃষ্টির মতো গুলি করছিল। সে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিল বলে বর্ণনা করেছে।
প্রতিবেদনটি এমন ঘটনাগুলোও নথিভুক্ত করেছে, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী আহত বিক্ষোভকারীদের জরুরি চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগ নাকচ বা বাধাগ্রস্ত করেছে। নিরাপত্তা বাহিনী রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং হাসপাতালগুলো থেকে তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেছে। তারা চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত কর্মীদের ভয় দেখিয়েছে এবং হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করেছে। এ থেকে পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পায়, আইনানুগ প্রক্রিয়া ছাড়া বিক্ষোভকারীদের শনাক্ত করার এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংসতার মাত্রা কোন পর্যায়ে ছিল তা গোপন করার চেষ্টা করা হচ্ছিল।
যখন সাবেক সরকার দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছিল, তখন সংঘটিত প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড এবং আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকদের, পুলিশ এবং মিডিয়াকে লক্ষ্য করে করা অন্যান্য গুরুতর প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনাগুলোও প্রতিবেদনে নথিভুক্ত করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিন্দু, আহমদিয়া মুসলিম এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর ‘আদিবাসী’ জনগণও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। যদিও বিভিন্ন ধর্মীয় ও ‘আদিবাসী’ গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় ১০০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। তবে অনেক প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং এসব গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের পরও অপরাধীরা এখনো দায়মুক্তি উপভোগ করছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর বাংলাদেশ নিয়ে সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদন এবং সুপারিশগুলো অনলাইনের মাধ্যমে ভুক্তভোগী ও অন্যান্য ২৩০ জন বাংলাদেশির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রণয়ন করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের আরো ৩৬টি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে এই বিক্ষোভের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাবেক ও বর্তমান জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও আছেন। তথ্য-উপাত্তগুলোর সত্যতা ভিডিও এবং ফটো, মেডিক্যাল ফরেনসিক বিশ্লেষণ, অস্ত্র বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ সাপেক্ষে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। একটি ঘটনা বা অপরাধ ঘটেছে এবং তা বিশ্বাস করার মতো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে সেগুলোও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর অনুসন্ধান করেছে। একজন অপরাধীর অপরাধ প্রমাণের জন্য এসব প্রমাণক হিসেবে ফৌজদারি কার্যধারায় অপরাধ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় মানদণ্ডের চেয়ে কম। তবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আরো ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।