ডেস্ক রির্পোট:- সংঘাত-সংঘর্ষের পর অবশেষে আসলো ‘সম্মানজনক পৃথক্করণ’র সিদ্ধান্ত। প্রায় ৮ বছর অধিভুক্ত থাকা রাজধানীর ৭ সরকারি কলেজের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন শিক্ষাবর্ষে আর কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি নেবে না দেশের শীর্ষ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। তার আগে পদ্মার জল গড়িয়েছে অনেক দূর। দীর্ঘ এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অধিভুক্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে আপত্তি। রাজপথে নেমে এসে জনদুর্ভোগ তৈরি করা। শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) হামলা। এরই ধারাবাহিকতায় সবশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) প্রফেসর ড. মামুন আহমেদের কার্যালয়ে গিয়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের হট্টগোল। ৫ই জানুয়ারি দেয়া পাঁচ দফা দাবি আদায়ে তাৎক্ষণিক চাপ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ‘মব’ তৈরি না করতে কড়া ভাষায় প্রো-ভিসির সতর্ক করা। রোববার সন্ধ্যার এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রো-ভিসির বিরুদ্ধে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ‘অসম্মান’ করার অভিযোগ আনা হয়। দাবি করা হয় প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার। এ নিয়ে রাতে অবরোধ করা হয় রাজধানীর পাঁচ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। দীর্ঘ চার ঘণ্টা অবরোধের পর সড়ক ছেড়ে শিক্ষার্থীরা প্রো-ভিসির বাসা ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেন। রওয়ানা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে। এমন খবরে মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণে পাল্টা অবস্থান নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যেটি এক পর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নেয়। রাতে প্রো-ভিসির দুঃখ প্রকাশেও সমাধান মেলেনি। গতকাল দুপুর অবধি চলতে থাকে উত্তেজনা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী দুপুর সাড়ে ১২টায় সাত কলেজ ইস্যুতে বৈঠকে বসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদ খান। ভিসির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে প্রো-ভিসি (প্রশাসন) প্রফেসর ড. সায়মা হক বিদিশা, প্রো-ভিসি (শিক্ষা) প্রফেসর ড. মামুন আহমেদ, ট্রেজারার প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদসহ বিভিন্ন অনুষদের ডিন উপস্থিত ছিলেন। সাত কলেজের পক্ষ থেকে অংশ নেন কলেজগুলোর অধ্যক্ষরা। বৈঠক শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদ খান বৈঠকের সিদ্ধান্তের কথা জানান। বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত সাত কলেজের সম্মানজনক পৃথক্করণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ ছাড়াও অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক বছর এগিয়ে এনে এ বছর থেকেই অর্থাৎ ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি না নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ২৯শে ডিসেম্বর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সভায় জোর সুপারিশ করা হয়; ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী আসন সংখ্যা ও ভর্তি ফি নির্ধারণসহ যাবতীয় বিষয়ে মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে; যেসব শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীল থাকবেন, যাতে তাদের শিক্ষাজীবন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তবে এমন সিদ্ধান্তে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মইনুল ইসলাম বলেন, আমাদের এক নম্বর দাবি অধিভুক্তি বাতিল হয়েছে। এ জন্য আমরা সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আমাদের আরও পাঁচটি দাবি আছে। প্রো-ভিসির পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবি আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেনে নিতে হবে। অন্যথায় আমরা নিউ মার্কেট থানা ঘেরাও করবো।
শিক্ষার মানোন্নয়ন ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাপ কমানোর লক্ষ্যে সরকারের উদ্যোগে রাজধানীর সরকারি সাত কলেজকে অধিভুক্ত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। যেখানে এ দু’টি বিষয় ছাড়াও গুরুত্ব পেয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশীদের কোন্দল। কোনো রকম পর্যালোচনা ছাড়াই এক বিকালে হুট করে ঘোষণা করা হয়- ‘রাজধানীর সরকারি সাত কলেজ আজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত।’ এরপর কেটেছে প্রায় ৮ বছর। কিন্তু সাত কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং কিছুদিন পর পর রাজপথে নেমে আসতে হয়েছে এসব কলেজের শিক্ষার্থীদের। অন্যদিকে সাত কলেজের এত বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিয়ে নিজের ঘরেই আলো দিতে ব্যর্থ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেক সময় দাবি তুলেছিল- সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের। যে দাবি করতে গিয়ে তৎকালীন সরকারের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) হামলার শিকারও হতে হয়েছে তাদের। নিপীড়নের শিকার হয়েছেন নারী শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ই জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদ খানকে পাঁচ দফা দাবি জানায় সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
দাবিগুলো হলো- ২০২৪-২৫ সেশন থেকেই সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিল করা; শ্রেণিকক্ষের ধারণক্ষমতার বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি না করানো; শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো; নেগেটিভ মার্ক যুক্ত করা; সাত কলেজের ভর্তি ফি’র স্বচ্ছতা নিশ্চিতে, মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাবি ব্যতীত নতুন অ্যাকাউন্টে ভর্তি ফি’র টাকা জমা রাখা। এরই ধারাবাহিকতায় গত রোববার সন্ধ্যায় অফিস সময়ের পরে সাত কলেজের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) প্রফেসর ড. মামুন আহমেদের কার্যালয়ে যান। সেখানে এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা প্রো-ভিসির সঙ্গে হট্টগোল শুরু করেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় মব তৈরি না করতে প্রো-ভিসি শিক্ষার্থীদের কড়া ভাষায় সতর্ক করেন। যে ঘটনাকে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অপমান বলে দাবি করেন তারা। এরপর সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাব, শাহবাগ, মিরপুর, তাঁতীবাজার, নিউমার্কেট সড়কে অবরোধ করেন। দাবি করা হয় প্রো-ভিসির ক্ষমা চাওয়ার। চার ঘণ্টায়ও দাবি মানা না হলে অবরোধ তুলে নিয়ে প্রো-ভিসির বাসা ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেন তারা। রওয়ানা হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত মোড়ে গেলে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের নিচে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে এমন খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্ষুব্ধ হন। তারা ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের ঠেকাতে পাল্টা অবস্থান নেয় স্যার এ এফ রহমান হলের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে হলগুলো থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নেয়। উত্তেজনা বাড়তে থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একযোগে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। তাড়া খেয়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন ঢাকা কলেজের সামনে চলে যায় তখন পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এ সময় দুই পক্ষের সংঘর্ষের বেশ কয়েকজন আহত হন। যাদের পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা দেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে রাতে প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. মামুন আহমেদ এক ভিডিও বার্তায় উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে চলতে থাকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। ঢাবি শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আবার এগিয়ে গেলে আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। রাত ২টার দিকে মোতায়েন করা হয় বিজিবি। এরই মধ্যে ইডেন কলেজের মেয়েরা রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ দেখান। রাত ৩টার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়। দুই পক্ষ স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসেন। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদ উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। আর সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পরদিন সকাল ৯টা থেকে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু মিটিংয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থেকে তারা এক পর্যায়ে ৪ ঘণ্টার জন্য সে কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেন। সবশেষ সন্ধ্যায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পাঁচ দফা দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে এদিনের মতো কর্মসূচি শেষ করেন।
এদিকে সাত কলেজ ইস্যুতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের দুই গ্রুপ। পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে সাত কলেজ বাতিলকরণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। অন্যদিকে বিকালে আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে জগন্নাথ হল ও স্যার এ এফ রহমান হল পরিদর্শন করেন ভিসি ড. নিয়াজ আহমদ খান। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ, জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট দেবাশীষ পালসহ সংশ্লিষ্ট হলের আবাসিক শিক্ষকগণ উপস্থিত ছিলেন। মানবজমিন