মহানবী (সা.)-এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ৯ দেখা হয়েছে

আসআদ শাহীন:- নবী করিম (সা.)-এর মহান ব্যক্তিত্ব এমন এক সমন্বিত আদর্শ—যেখানে শাসক, রাষ্ট্রনায়ক, সমাজবিদ, প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং অনুপম সংগঠকের গুণাবলি একত্রে

পূর্ণরূপে বিকশিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে যে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত শাসক ছিলেন এবং এই মর্যাদা তাঁকে রাসুলের দায়িত্বের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গিভাবে প্রদান করা হয়েছিল। এটি কখনোই এমন নয় যে তিনি নিজ প্রচেষ্টায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তার শাসক হয়ে উঠেছিলেন, কিংবা মানুষ তাঁকে ভোট দিয়ে তাদের শাসক হিসেবে নির্বাচিত করেছিল।

রাসুল (সা.)-এর শাসনক্ষমতা ও রিসালাত মূলত একই সত্তার অভিব্যক্তি।
একজন শাসক হিসেবে তাঁর আনুগত্য করা আল্লাহর আনুগত্যেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর বিরোধিতা করা মানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করা। তিনি নিজেই আমাদের শিখিয়েছেন যে রাসুলের প্রতি আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য থেকে আলাদা নয়; বরং এটি আল্লাহর আদেশের অধীনে। রাসুল, যিনি নবুয়ত ও রিসালাতের আমানতদার, নিজে কোনো স্বার্থসিদ্ধি বা আনুগত্য আদায়ের জন্য আসেননি; বরং আল্লাহর নির্দেশ পালনের পূর্ণাঙ্গ বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন।
পবিত্র কোরআনে রাসুল (সা.)-এর আনুগত্যের ব্যাপারে বলা হয়েছে—‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে শুধু এই জন্য প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর আনুগত্য করা হয়।’

(সুরা : নিসা, আয়াত : ৬৪)

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে : ‘যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করে, সে মূলত আল্লাহরই আনুগত্য করে।’

(সুরা : নিসা, আয়াত : ৮০)

আল্লাহ তাআলা আরো ঘোষণা করেছেন যে নবী করিম (সা.)-এর হাতে বায়াত করা প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর সঙ্গেই বায়াত করার সমতুল্য : ‘যারা আপনার কাছে বায়াত গ্রহণ করছে, তারা মূলত আল্লাহর কাছেই বায়াত গ্রহণ করছে।’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ১০)

আল্লাহ তাআলা নবী করিম (সা.)-এর শাসন ও সিদ্ধান্তের গুরুত্ব এভাবে ব্যক্ত করেছেন : ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যখন কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়সালা দান করেন, তখন কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর নিজেদের বিষয়ে কোনো এখতিয়ার বাকি থাকে না।
কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্যতা করলে সে তো সুস্পষ্ট গোমরাহিতে পতিত হলো।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৬)

আল্লাহ তাআলা নবীর বিরোধিতাকে এমন গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেছেন, যা মানুষের সত্কর্ম (আমল) ধ্বংস করে দেয় : ‘হে ঈমানদাররা! আল্লাহর আনুগত্য করো, তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের আমল বিনষ্ট করে দিয়ো না।’ (সুরা : মুহাম্মদ, আয়াত : ৩৩)

এসব কোরআনের আয়াত নবী করিম (সা.)-এর নবুয়ত ও রিসালাতের মর্যাদা ও তাঁর ব্যক্তিত্ব তুলে ধরে।

নবী করিম (সা.)-এর রিসালাত ও শাসক হিসেবে ভূমিকা একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত।

তাঁর ব্যক্তিত্ব কোরআনের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে মানবজাতির জন্য আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শাসক, রাজনীতিবিদ এবং ন্যায়নিষ্ঠ নেতা হিসেবে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহর নির্দেশিত আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়ন করেছেন, যা চিরকালীন দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। (হিফাজতে হাদিস, পৃষ্ঠা-৫০)

মদিনায় আগমনের পর নবী করিম (সা.) নিজের রিসালাতের পাশাপাশি শাসক ও প্রশাসকের ভূমিকায় মদিনার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন। মক্কায় তাঁর কাছে কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না, আর সেখানকার সমাজে তিনি শাসক হিসেবেও বিবেচিত হননি। তবে মদিনায় আল্লাহর নির্দেশনায় এবং তাঁর অসাধারণ দূরদর্শিতা ও প্রশাসনিক দক্ষতায় তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে ন্যায়পরায়ণতা, প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের উদাহরণ স্থাপন করা হয়। এখানে তিনি একই সঙ্গে ধর্মীয় নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে ধর্ম ও দুনিয়ার নেতৃত্ব একত্র হয়েছিল, তবে তিনি কখনো খ্রিস্টান পোপের মতো অহংকারে ভোগেননি কিংবা রোমান সম্রাটের মতো বিশাল সামরিক বাহিনী তাঁর ছিল না।

(ইনসানে কামেল, পৃষ্ঠা-৩৬০)

নবী করিম (সা.)-এর অতুলনীয় কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক গুণাবলি তাঁর মক্কার জীবনেও প্রমাণিত হয়েছিল। নবুয়তের পূর্ববর্তী দুটি ঘটনা তাঁর প্রজ্ঞা ও সামাজিক চেতনাকে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ করে। এর একটি হলো ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক শান্তিচুক্তি, যা নিয়ে তিনি গর্বভরে বলতেন, ‘আমি সেই চুক্তিতে অংশ নিয়েছিলাম।’ এটি ছিল সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

(তাবাকাতুল কুবরা, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১২৮)

দ্বিতীয় উদাহরণ হলো কাবা শরিফে হাজরে আসওয়াদ পুনঃস্থাপন। (সিরাতুন নববী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২০৯)

যখন বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে এই সম্মানজনক কাজটি নিয়ে তীব্র বিরোধ দেখা দেয়, তখন তাঁর দূরদর্শিতার মাধ্যমে এই বিবাদ মিটিয়ে ফেলা হয়। তিনি এমন এক সমাধান প্রদান করেন, যা সব পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়। তাঁর এই কাজের ফলে শুধু তাঁর মর্যাদাই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বগুণও প্রকাশ পেয়েছিল।

[হায়াতে মুহাম্মদ (সা.), পৃষ্ঠা-২৮১]

নবুয়তের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই মহানবী (সা.) একটি আন্দোলনের নেতা হয়ে ওঠেন। এর ফলে নবীজিকে অসংখ্য বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়, অসীম কষ্ট ও বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। তাঁর সঙ্গীদের ওপর চরম নির্যাতন চালানো হয়, তাঁদের জীবনের পথ সংকুচিত করে দেওয়া হয়। কিন্তু নবী করিম (সা.)-এর নবীসুলভ প্রজ্ঞা ও আল্লাহর সহায়তায় তিনি এই আন্দোলনকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম হন। যদি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় সামান্যতম ঘাটতি থাকত, তাহলে মক্কায় সংঘাতের সৃষ্টি হতো, আর মুসলিমদের ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস হয়ে যেত।

(সিরাতুন নববী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩১০-৩৩৯)

নবী করিম (সা.)-এর নেতৃত্বে আল্লাহর সহায়তা ও নবীসুলভ দূরদর্শিতা সব সময় কার্যকর ছিল। যখন তিনি দেখলেন মক্কা তাঁর আন্দোলনের জন্য উপযুক্ত কেন্দ্র নয়, তখন তিনি এর বাইরে একটি নিরাপদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেন। প্রথমে তিনি মুসলিমদের একটি দলকে হাবশায় হিজরত করার অনুমতি দেন, পরে নিজেই মদিনায় হিজরত করেন। মক্কার সময়কালে ইয়াসরিব (মদিনা) থেকে আসা বায়াতগুলো তাঁর এই রাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ। (তাবাকাতুল কুবরা, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২০৩-২০৭)

নবী করিম (সা.) তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে ইসলামের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তোলেন, যা পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে দেয়।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

arfasadibnsahin@gmail.com

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions