ডেস্ক রির্পোট: – ফের আলোচনায় বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক। অতিসম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিস্ফোরক মন্তব্যে রাজনীতিতে নতুনভাবে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহলও তৈরি হয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির মাঠে সরব হওয়ার পর দল দুটির মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তৃণমূল থেকে শুরু করে দল দুটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য ও কথাবার্তায়ও এই মতবিরোধ স্পষ্ট হয়েছে গত কয়েকদিনে। মূলত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন আয়োজনে সময় দেওয়া নিয়ে এ ধরনের বৈরী সম্পর্কের লক্ষণ প্রকাশ্যে আসে গত আগস্টের মাঝামাঝি। এ নিয়ে উভয় দলের শীর্ষ নেতাদের যে বাহাস চলছে, তা তাদের বক্তব্যেই ফুটে উঠছে। মূলত ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে বড় দুই দলই যার যার অবস্থান থেকে তৎপরতা চালাচ্ছে।
শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সংশ্লিষ্ট কয়েকজন নেতা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন দল গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ভেতরে ভেতরে সহযোগিতা করছে। তারা নির্বাচনী জোট করে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার প্রচেষ্টায় রয়েছে। মিত্রদের পাশাপাশি বিএনপিও এ ধরনের ধারণা করছে। ফলে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা বাগযুদ্ধে জড়িয়েছেন। গত ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সমালোচনা করে বলেছেন, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। পাল্টা বিবৃতি দিয়ে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াতে ইসলামী বলছে, তারা ঘোলা পানিতে মাছর শিকার করে না। বরং বিএনপি নিজেদের দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে না পেরে আবোল-তাবোল বকছে। এই ঘটনায় আবারও নতুনভাবে সাধারণের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কি বিএনপি-জামায়াতের মাঝে ফাটল দেখা দিয়েছে! জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর প্রশাসন, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা সরে যাচ্ছেন। সেসব জায়গায় নিজস্ব লোকের পদায়ন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেও এক ধরনের নীরব মনোমালিন্য চলছে।
২৫ বছরের রাজনৈতিক মিত্রদের মধ্যে হঠাৎ কেনো এমন বৈরী সম্পর্ক তৈরি হলো, সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের বিষয়ে দুই দলের মতের মিল থাকলেও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ইস্যুতে বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার পতনের পর পুনর্গঠিত ক্ষমতা কাঠামোতে সবার সমান সুযোগ নেই। সেজন্যই পরস্পরের বাগযুদ্ধ হচ্ছে। এই সরকারের উচিত ৫ আগস্ট ঘিরে সব রাজনৈতিক দলসহ স্টেকহোল্ডারদের ক্ষমতা কাঠামোতে স্থান দেওয়া। তা না হলে ঐক্য হবে না।
যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রাজনৈতিক তর্কবিতর্কে আওয়ামী লীগের চুরি, লুটপাটের চিত্র নিচে পড়ে যাচ্ছে। তারা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ যে ধ্বংস করে দিয়েছে দেশটাকে, অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিয়েছে, এটা মানুষ ভুলে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক বছর ধরে দল দুটির সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। শেখ হাসিনার পতনের লক্ষ্যে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াত ছিল না। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে দল দুটির সম্পর্কের টানাপোড়েন কিছুটা কমে আসে। দুই দলই আন্দোলনে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জামায়াত জুলাই অভ্যুত্থানের বড় শক্তি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। সেটিও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াত এখন দ্বৈত ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে বিএনপি ও এর মিত্রদের মধ্যে। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এসব অভিযোগ মানতে রাজি নন। দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, তারা দ্বৈত ভূমিকায় নেই। তারা অন্যান্য দলের মতো প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন চাইছেন।
বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে যে ছেদ পড়েছে, তার প্রমাণ মিলেছে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যে। গত ২৯ ডিসেম্বর সকালে শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত শেষে জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বেশকিছু মন্তব্য করেন। তিনি বলেছেন, ‘শুধু পার্শ্ববর্তী দেশই অপপ্রচার করছে না, দেশের দু-একটি রাজনৈতিক দল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়।… শেখ হাসিনার আমলে যারা লুট করেছে, সেই এস আলমদের উত্তরসূরি হয়ে ব্যাংক দখল করেছে অনেকে। বড় বড় কথা বলে বিএনপির নামে কলঙ্ক লেপন করছে। পাড়া-মহল্লায়, জেলায় জেলায় অনেক টার্মিনাল দখল, টেন্ডারবাজিসহ নানা কিছু দখল করেছে একটি দল। সেই রাজনৈতিক দলটিকে বলতে চাই, খুব নীরবে-নিভৃতে সব অপকর্মের সঙ্গে আপনারা জড়িত। ৫ আগস্টের পর একটি রাজনৈতিক দলের আত্মসাৎ দেখেছে জনগণ। কারা ব্যাংক আত্মসাৎ করেছে, সেটা জনগণ দেখেছে। কারা পায়ের রগ কাটে, তাদের চেনে জনগণ।
ওইদিন রাতেই রিজভীর বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান এক বিবৃতিতে বলেন, রিজভীর বক্তব্য বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রিজভী জামায়াতের বিরুদ্ধে এসব কথা উচ্চারণ করে কী অর্জন করতে চান, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। জামায়াত রগকাটা ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের রাজনীতি কখনো করেনি। রিজভীর বক্তব্য চরম মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা রিজভী বলেছেন, আমি সেই রাজনৈতিক দলকে বলতে চাই, ইসলামপন্থি সেই রাজনৈতিক দল, একাত্তরে আপনাদের ভূমিকা কী ছিল?
দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেশ বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় জামায়াতের। এরপর বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে ১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর জোট বাঁধে জামায়াতে ইসলামী। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে কিছু টানাপোড়েন তৈরি হলেও জোট নিয়ে কোনো ধরনের সংকট তৈরি হয়নি। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একসঙ্গে অংশ নেয় দল দুটি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ একটানা সাড়ে পনেরো বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করেছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতের শুধু না বিএনপিরও এক নেতার ফাঁসি হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গৃহবন্দি ছিলেন। এই সময় জামায়াত-বিএনপির মধ্যে নানা সংকট হলেও রাজনৈতিক জোট ছিল দুই বছর আগ পর্যন্ত। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দুদল আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভেঙে দিয়ে সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনে শুরু করে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরই সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক, নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়া কিংবা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান—সব জায়গায় বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গেই অংশ নিয়েছে। তাদের সঙ্গে ছিল গত পনেরো বছর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে থাকা অন্য আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলও। কিন্তু পাঁচ মাসের মাথায় নানা ইস্যুতে দল দুটির মতবিরোধ রাজনীতির মাঠে আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, সমস্যা তো নেই। রাজনৈতিক বক্তব্য সহজভাবেই গ্রহণ করা ভালো। জামায়াতের বর্তমান আমির শফিকুর রহমান জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। জাসদ ছাত্রলীগ তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংগঠন। সেই অর্থে জামায়াতের আমির তো মুক্তিযুদ্ধের মানুষ। তিনি এখন যে দলে গেছেন, তাহলে স্পষ্ট করে বলুন যে, তারা অমুক সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, বিএনপির শীর্ষ নেতারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তা অসত্য, অনুমানভিত্তিক ও মনগড়া। তিনি বলেন, যে উদ্দেশ্যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, সেই প্রয়োজনীয়তা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। জামায়াতের বিরুদ্ধে দখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দখল করা মানে অন্যের মালিকানাধীন জিনিস জোর করে নিজের করে নেওয়া। আমরা তো সে ধরনের কিছু করিনি। প্রকৃতপক্ষে সবারই উচিত আগে নিজের দিকে তাকানো। তাহলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখবে যে, সে কোথায় রয়েছে। তারপর অন্যের বিষয়ে বলা উচিত।
দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বাগযুদ্ধ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, উভয় দলই পরস্পরের বিরুদ্ধে বলছে। কারণ হলো ৫ আগস্টের পর পুনর্গঠিত ক্ষমতা কাঠামোতে বিএনপির লোকজন হয়তো কম স্থান পেয়েছেন। সে কারণে তাদের অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। পুনর্গঠিত ক্ষমতা কাঠামোতে সবার সমান সুযোগ নেই। সেজন্যই পরস্পরের বাগযুদ্ধ হচ্ছে। এই সরকারের উচিত ৫ আগস্ট ঘিরে সব রাজনৈতিক দলসহ স্টেকহোল্ডারদের ক্ষমতা কাঠামোতে স্থান দেওয়া। তা না হলে ঐক্য হবে না। আমাদের অবস্থান থেকে এমন কিছু বলা ঠিক নয়, যাতে ঐক্য বিনষ্ট হয়।কালবেলা