ডেস্ক রির্পোট:- গত ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় বাসের ধাক্কায় ছয়জন নিহত হন। বাসটির ফিটনেস সনদ নেই। চালকের লাইসেন্স দুই বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ। তা ছাড়া রুট পারমিট নেই অনেকের। সেগুলো দেখারও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। ফলে এসব বাস-মিনিবাস বেপরোয়া গতিতে সড়ক দাপিয়ে বেড়ায়। প্রতিনিয়ত সড়কে এভাবেই অসংখ্য তাজা প্রাণ ঝরে গেলেও এই চিত্র চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। দুর্ঘটনার পর কয়েকদিন লেখালেখি আর আলোচনার পর সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক!
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে মোট ৬৭৮টি আর এতে নিহত হন ৪০৪ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে সড়ক দুর্ঘটনা মোট ৮৭৪টি আর এতে নিহত হন ৫২৩ জন, মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনা মোট ৯৫৫টি আর এতে নিহত হন ৫৫০ জন, এপ্রিল মাসে সড়ক দুর্ঘটনা মোট ১০৫৬টি আর এতে নিহত হন ৬৩২ জন, মে মাসে সড়ক দুর্ঘটনা মোট ৭৬৮টি আর এতে নিহত হন ৪৫৭ জন।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের এক হিসাব বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে ৬৬ হাজার ৬৬১টি ফিটনেসবিহীন যানবাহন দায়ী। আরেক হিসাব অনুযায়ী, ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দুর্ঘটনার জন্য ১১ হাজার ৯২৯টি যানবাহন দায়ী। এর মধ্যে ফিট গাড়ির সংখ্যা ৮ হাজার ১৮টি, আনফিট গাড়ি ২ হাজার ৪৪৫টি।
আরেক হিসাব অনুযায়ী, ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দুর্ঘটনার জন্য ১১ হাজার ৯২৯টি যানবাহন দায়ী। এর মধ্যে ফিট গাড়ির সংখ্যা ৮ হাজার ১৮টি, আনফিট গাড়ি ২ হাজার ৪৪৫টি এবং অন্যান্য ১ হাজার ৪৬৬টি।
এ বিষয়ে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘বিআরটিএ অনেকবার জরিমানা ছাড়াই ফিটনেস সনদ হালনাগাদের সুযোগ দিলেও তেমন সাড়া দিচ্ছেন না মালিকরা। ফিটনেস সনদ ছাড়াই চলাচলের অনুপযোগী গাড়ি সংশ্লিষ্টদের বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে চালানোর চেষ্টা করেন তারা।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে চলাচলের জন্য যে কোনো ভেহিক্যালের যান্ত্রিক ও কাঠামোগত ফিটনেস থাকতে হয়। তবে পুরো প্রক্রিয়াটি দেখভাল করার মতো প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও পদ্ধতিগত সক্ষমতা এই মুহূর্তে বিআরটিএর নেই। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটির আন্তরিকতার অভাবের পাশাপাশি লোকবল সংকটও রয়েছে। যদিও অর্থের বিনিময়ে ফিটনেসহীন গাড়িকে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ আছে।
বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, বিআরটিএর সবচেয়ে ব্যস্ত সার্কেল মিরপুরে (মেট্রো-১)। এ সার্কেলে মোটরযান পরিদর্শকের পদ ১৯টি। তাদের মধ্য থেকে ১০ জন গাড়ির ফিটনেস যাচাই করেন। বছরে প্রায় ৫ লাখ গাড়িকে ফিটনেস সনদ নিতে হয়। প্রতিদিন একজন পরিদর্শককে গড়ে ২০০ গাড়ির ফিটনেস যাচাই করতে হয়। ১০০ গাড়ির ফিটনেস দিতে হলে গাড়িপ্রতি সর্বোচ্চ ৪ মিনিট সময় পান। এত কম সময়ে গাড়ির মান যাচাই সম্ভব নয়।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের গাড়ি নিয়ে খুব ঝুঁকির মধ্যে আছি। প্রতিনিয়তই স্থানীয় পর্যায়ের গাড়ি তথা নছিমন-করিমন গাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট দূরের কথা, চালক ও গাড়িরও কোনো নিবন্ধন নেই।
তিনি বলেন, এসব গাড়ির কাগজপত্র ও ফিটনেস সনদ তো বিআরটিএ দেয় না, তাহলে কোন আইনি শক্তিতে এসব গাড়ি সড়কে চলে? গাড়ির ফিটনেস দেখার পাশাপাশি এসব রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ির বিষয়েও ভেবে দেখা এখন সময়ের দাবি।
যানবাহনের ত্রুটি ও লাইসেন্স সংক্রান্ত সব বিষয় দেখার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের হলেও দায়িত্ব নিয়ে চলছে অবহেলা। অবৈধ পরিবহনের সংখ্যা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে।
জানা গেছে, সড়কে বর্তমানে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ৬ লাখ ১৮ হাজার ৪৮৮টি। এর মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স ৩৯৯৩টি, অটোরিকশা ২ লাখ ৪৪ হাজার ৩টি, অটো টেম্পো ৬ হাজার ৭৮টি, বাস ২৫ হাজার ২১০টি, কার ৫৯ হাজার ১৭৪টি, কার্গো ভ্যান ২ হাজার ৩১০টি, কাভার্ডভ্যান ১০ হাজার ৪৯১টি, ডেলিভারিভ্যান ৯ হাজার ৮১৮টি, হিউম্যান হলার ১৪ হাজার ৬৮১টি, জিপ ১৪ হাজার ২৩৫টি, মাইক্রোবাস ২৬ হাজার ৫৯৮টি, মিনিবাস ১২ হাজার ৪৩৮টি, পিকআপ ৭৮ হাজার ৯৯৬টি, স্পেশাল পারপাস ভেহিকল ৬ হাজার ৯৩টি, ট্যাঙ্কার ২৩৩৪টি, ট্যাক্সিক্যাব ৭ হাজার ৩৬টি, ট্রাক ৬৭ হাজার ৯১৯টি এবং ট্রাক্টর ৩৭ হাজার ৮৩৬টি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, গত আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে ৩২ হাজার ৭৩৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫ হাজার ৩৮৪ জন নিহত হয়েছেন। এতে ৮৭ হাজার ৮৮৪ কোটি ১২ লাখ ৪১ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
অন্যদিকে, যাত্রী কল্যাণ সমিতি সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, দুর্নীতি, চরম অব্যবস্থাপনা, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্যে ২০১৪ সাল থেকে ১১ বছরে দেশে ৬০ হাজার ৯৮০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৪৭ জন নিহত হয়েছেন।
বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, এটি দেখার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের। তাদের লোকবলও আছে। তাদের জিজ্ঞাসা করেন কীভাবে এসব গাড়ি সড়কে নামছে। আমরা তো অভিযান চালাচ্ছিই। আর কী করতে পারি?
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতা, চাঁদাবাজি এবং অনৈতিক অর্থ লেনদেন। তা ছাড়া পুলিশের বাধা তো রয়েছেই।
এদিকে এক মাসের মধ্যে রাজধানীতে চলাচলকারী সব ধরনের যানবাহনের ফিটনেস নিশ্চিত করা না হলে বিআরটিএর বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বলে গত ১৯ ডিসেম্বর সতর্ক করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।
এর আগে ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই এক আদেশে ঢাকাসহ সারা দেশে লাইসেন্স নিয়ে ফিটনেস নবায়ন না করা গাড়িগুলো দুই মাসের মধ্যে ফিটনেস নবায়ন করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে ফিটনেসবিহীন ও নিবন্ধনহীন যান চলাচল এবং লাইসেন্স ছাড়া যান চালানো রোধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার সংবলিত সংবিধানের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদের চেতনা বাস্তবায়নে মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩ সহ সংশ্লিষ্ট সব আইন কঠোরভাবে মেনে চলতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়।
৭১ হাজার ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ে ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব আদেশ দেন।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত বছরের মে মাসে ২০ বছরের পুরোনো বাস এবং ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক বন্ধে যানবাহনের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করেছিল। মালিকদের চাপে নির্বাচনে প্রভাবের আশঙ্কায় পড়ে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা বলেছেন, এই সরকারের কেউ নির্বাচন করবে না, তাই এগুলো বন্ধ করে যাব।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেন, দাবি-দাওয়া নিয়ে যে যখন ইচ্ছা সড়কে বসে পড়ছে। রাস্তা বন্ধ হয়ে যানজট হচ্ছে। সড়কে অবৈধ ফিটনেসবিহীন ও নিবন্ধনহীন গাড়ি চলছে, উল্টোপথে গাড়ি চলছে—এগুলো সত্য কথা। ট্রাফিক এবং হাইওয়ে পুলিশও পুরোপুরি সক্রিয় নয়।
এ বিষয়ে যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক উত্তর) সুফিয়ান আহমেদ বলেন, আমরা নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে অভিযান চালিয়ে থাকি। যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। এটি তো আর আমরা দিই না। সনদ ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি পেলে ডাম্পিং করা হয়, মামলা দেওয়া হয়।কালবেলা