ডেস্ক রিপেৃাট:- শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে-পরে তিন দিনের মধ্যে থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের বেশ কিছু স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়।
এসব অস্ত্রের বেশিরভাগ উদ্ধার করা গেলেও এখনবধি কারাগারের ৫৭টি রাইফেল ও পুলিশের ১৩৯৯টি অস্ত্র অর্থাৎ মোট ১৪৫৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি।
বিষয়টিকে দেশের নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সারা দেশে পুলিশি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ সদস্যরা থানায় আসতে সাহস পাননি। প্রথম দিকে স্থাপনা পাহারা দেওয়ার জন্য আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে ধীরে ধীরে থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে থাকে।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই পুলিশ লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র জমার দেওয়ার জন্য নির্ধারিত সময় বেঁধে দেয়। সময় শেষ হওয়ার পরপরই লুট হওয়ার আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের পুলিশ অভিযানে নামে, যা এখনো চলমান।
এরইমধ্যে লুট হওয়া অনেক অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধারে সক্ষম হয়েছে।
তবে এখনবধি যেসব অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করা যায়নি পারেনি সেগুলোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্ত্রগুলো যদি সন্ত্রাসীদের হাতে গিয়ে থাকে তাহলে এটা নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ইনামুল হক সাগর বাংলানিউজকে বলেন, সে সময় ৫৮টি থানায় অগ্নিসংযোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৫৬টি থানায় ভাঙচুর হয়। আনুমানিক মোট ১১৪টি থানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ সময় পুলিশের অস্ত্র লুট হয় ৫৭৫০টি। ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার হয় ৪৩৫১টি। আরও ১৩৯৯টি অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া গোলাবারুদ লুণ্ঠিত হয় ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯। উদ্ধার করা হয় ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৩৯।
উদ্ধার করা লুট হয়ে যাওয়া অস্ত্র
এদিকে কারাগার থেকে জানা যায়, জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের সময় নরসিংদী কারাগারে হামলার সময় রক্ষিত ৮৫টি চাইনিজ রাইফেল লুটের ঘটনা ঘটে। এখন পর্যন্ত ৫৭টি চাইনিজ রাইফেল উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বাকি ২৪টি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
লুট হওয়া অস্ত্রগুলো এখন কোথায় – এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশের বেশিসংখ্যক মানুষ সড়কে নেমে সরকার পতন ঘটিয়েছে। এ আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরপরই পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটে। আমরা মনে করি, সে হামলার ঘটনার পেছনে সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল, যারা লুটপাট চালিয়েছে, অস্ত্র লুট করেছে। কারণ, যারা ফ্যাসিস্ট সরকারকে আন্দোলনের মাধ্যমে হটিয়েছে তারা কখনো কোনো স্থাপনায় হামলা করতে পারে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ যে অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার করতে পারেনি, সেই অস্ত্রগুলো কোথায়? সে অস্ত্রগুলো যদি সন্ত্রাসীদের কাছে গিয়ে থাকে তাহলে নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি।
উদ্ধার করা লুট হয়ে যাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) নতুন দায়িত্ব নেওয়া ঢাকা বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। এ সময় কারাগারে থাকা ৮২৬ জন বন্দি পালিয়ে যায়। সে সময় ৮৫টি চাইনিজ রাইফেল লুটের ঘটনা ঘটে। তবে এখন পর্যন্ত ৫৭টি চাইনিজ রাইফেল উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা। বর্তমানে ২৪টি চাইনিজ রাইফেল উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখনো যে উদ্ধার হয়নি, সেটা তো উদ্বেগের। এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাইরে থাকলে যে কোনো সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে যায়। এছাড়া ৫ আগস্টে পুলিশের যেসব স্থাপনে হামলা হয়েছে সেখানে সম্ভবত সন্ত্রাসীরা মিশে হামলাগুলো চালিয়েছে। বাকি অস্ত্রগুলো উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। ’
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক জানান, লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ জেলপলাতক আসামি, দাগি সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থি, চরমপন্থি, কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অপর একটি সূত্র জানান, লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি (স্মল মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন ধরনের গুলি।
কারা অধিদপ্তরে বেশ কয়েকদিন আগে সংবাদ সম্মেলন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, আগস্টে অস্থিরতার সময়ে আটটি কারাগার থেকে অস্ত্র লুট হয়েছিল ৯৪টি। এর মধ্যে ৬৫টি উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল শনিবার ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার গুলশান থানা পুলিশ জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে সংবাদে সেন্টু মিয়া (৪৮) নামে একজনকে অবৈধ পিস্তলসহ গ্রেপ্তার করেছে।
পুলিশ বলছে, স্থানীয় ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসার দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার জন্য অস্ত্রসহ ঘটনাস্থলে যায় ওই ব্যক্তি।
সম্প্রতি সারা দেশে খুন, ছিনতাই, চুরি ও ডাকাতির মতো ভয়ংকর অপরাধ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। রাত যত গভীর হতে থাকে সড়কের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় এসব অপরাধীদের হাতে। বিশেষ করে রাজধানীতে এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিনতাই নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পূর্ব শত্রুতা, ব্যক্তিগত বিরোধ ও আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির ঘটনা বেড়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে এখন অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলানিউজ