ডেস্ক রির্পোট:- দেশে নৃশংস, লোমহর্ষক খুনের ঘটনা পুরনো নয়। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত বাড়ছে অপরাধও। মা খুন করছে সন্তানকে, ভাই খুন করছে ভাইকে, স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে আবার প্রেম-পরকীয়া ও রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হচ্ছে অনেকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক বিরোধ, পূর্ব-শত্রুতার জের, সামাজিক, আর্থিক টানাপড়েনের সঙ্গে রয়েছে হতাশা। পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, ছিনতাই, ডাকাতি, কথা কাটাকাটি ও বিভিন্ন ব্যক্তিস্বার্থের ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে একের পর এক ঘটছে হত্যাকাণ্ড।
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ পাঁচ বছরে সারা দেশে ১৬ হাজারের বেশি মানুষ খুনের শিকার হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৬ হাজার ৫৫৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের শেষ এগারো মাসে ৩ হাজার ৮০৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ বছরের শেষ পাঁচ মাসে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ২৭১টি।
গত ১৫ই নভেম্বর রাজধানীর ধানমণ্ডিতে একটি বাড়িতে আব্দুর রশিদ (৮৫) নামে এক প্রবাসী চিকিৎসককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় মো. নাইম (২২), জাহিদুর রহমান রিফাত (২০) ও আবু তাহের শিকদার ওরফে শাওন (২২) নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ডিএমপি’র রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদ আলম জানান, গত ১৫ই নভেম্বর রাত আড়াইটার দিকে শাওনকে সঙ্গে নিয়ে ওই দুই জন সীমানা প্রাচীর টপকে আব্দুর রশিদের বাসায় প্রবেশ করে। আব্দুর রশিদ অভিযুক্তদের উপস্থিতি টের পান। প্রবেশের পর ভুক্তভোগীর সঙ্গে দুষ্কৃতকারীদের ধস্তাধস্তি হয়। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সুফিয়া রশিদ পাশের কক্ষ থেকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে একজন তার মুখ চেপে ধরে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে দুষ্কৃতকারীরা ধারালো চাকু দিয়ে রশিদের বুকে একাধিকবার আঘাত করে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে বুধবার গাজীপুরের টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় চার জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। গত ২০শে অক্টোবর রাতে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে মো. ইমরান (২২) নামে এক শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তিনি মিরপুর বাঙলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। নিহতের ভাই মো. সুমন বলেন, আমার ভাই মিরপুর বাঙলা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের শিক্ষার্থী ছিল। সেদিন রাতে বাদশা নামের স্থানীয় এক সন্ত্রাসী আমাদের বাসা থেকে টেলিফোনে তাকে ডেকে নিয়ে যায়। পরে আমার ভাইকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে সারা দেশে হত্যা মামলা হয় ৩ হাজার ৬৫৩টি, তারমধ্যে ডিএমপি’তে ২০৮টি, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৫৩৯টি, তারমধ্যে ডিএমপি’তে ২১৯টি, ২০২১ সালে ৩ হাজার ২১৪টি, ডিএমপি’তে ১৬৬টি, ২০২২ সালে ৩ হাজার ১২৬টি, ডিএমপি’তে ১৭২টি, ২০২৩ সালে ৩ হাজার ০২৩টি, তারমধ্যে ডিএমপি’তে ১৬৫টি এবং ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৮০৪টি, তারমধ্যে ডিএমপি’তে ৫১৪টি হত্যা মামলা হয়। চলতি বছরের (জুলাই-নভেম্বর) পর্যন্ত সারা দেশে হত্যা মামলা হয় ২ হাজার ২৭১টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, দেশের বাস্তবতায় কোনো একটি রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখনকার অপরাধের পরিস্থিতি একরকম থাকে। অরাজনৈতিক কোনো সরকার থাকে তখনকার অপরাধ পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যেও একটা ভিন্নতা রয়েছে। বর্তমান সময়ে অপরাধ প্রবণতা, সহিংসতা, সংঘাত, খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এই ধরনের অপরাধগুলো অনেক কমে আসার কথা, এটাই আমরা প্রত্যাশা করেছি কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত। একটি রাজনৈতিক দলের সরকারের পতনের পর নতুন যে অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসেছেন তাদের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরপূর্ণভাবে স্বাভাবিক হয়নি।
আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার নিশ্চিত করতে পারি না। এই বিচার নিশ্চিত করতে না পারা দুইটা কারণে সেটি হচ্ছে- আইন বা মামলা পরিচালনার প্রক্রিয়াগত ধাপে কিছু জটিলতা রয়েছে এবং কিছু কিছু মামলা আছে যেটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করে মামলাটিকে বিলম্বিত করে। দেশে একটি চক্রই তৈরি হয়েছে যারা অপরাধটি তার আয়-উপাজর্নের উৎস মনে করছে। বর্তমান সরকার জনআকাঙ্ক্ষার সরকার। জনআকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলো ছিল কোনো ধরনের হয়রানি হবে না, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা থাকবে না, মানুষ তার স্বাধীন ভাবে চলতে পারবে আইন এবং সাংবিধানিকের পরিপ্রেক্ষিতে কিন্তু সেটি তো হচ্ছে না। পুলিশ, প্রশাসন বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাই যে একেবারে ভালো হয়ে গেছে সেটি কিন্তু নয়। এই জুলাই বিপ্লবের মধ্যদিয়ে যদি মানুষের পরিবর্তন না হয়, মানবিকতা না আসে তাহলে তো এটি বৃথা হয়ে যাবে- সেটি যে সরকারই থাকুক না কেন? যেই অপরাধী হোক, তার পরিচয় শুধুই অপরাধী।
তিনি আরও বলেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই বলছেন তারা এখনো পরিপূর্ণভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারছে না; তবে আগের থেকে মাত্রা কিছুটা বেড়েছে। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতা যাদেরকে আমরা হারিয়েছি, যারা শহীদ হয়েছেন সেই বিচারের জন্য কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কিন্তু যে সমস্ত পুলিশ নিহত হয়েছেন; কাদের হামলায় তারা নিহত হলেন- এরকম কোনো আইনগত ব্যবস্থা আমরা কিন্তু লক্ষ্য করিনি। দেশে সামান্যতম পরিস্থিতি তৈরি হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে আমরা যতই আলোচনা-সমালোচনা করি না কেন তাদের উপরেই নির্ভর করতে হয়। সেই নির্ভরতার জায়গা থেকে তাদের যে জুলাই বিপ্লবের পরে পূর্ব-প্রস্তুতি, অবস্থান-মর্যাদা, নৈতিক মনোবল বা সংকটকে দূরীভূত করার প্রস্তুতি বা এই অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার করার জন্য যে ব্যবস্থা, মাঠ পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ের যে সমন্বয়টা এই জায়গাতে ঘাটতি রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, বিভিন্ন কারণে খুনের ঘটনা ঘটছে। এটি সংখ্যায় কখনো কমে আবার কখনো বাড়ে। এসব মামলা তদন্তে গিয়ে দেখা যায় জমি সংক্রান্ত বিরোধ, পারিবারিক বিবাদ, রাজনৈতিক ক্ষোভ, পরকীয়া, মাদক বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণে হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়ে থাকে। দেশে খুন সহ সকল অপরাধের মাত্রা যাতে কমিয়ে আনা যায় এবং অপরাধীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশ সর্বদা তৎপর রয়েছে।মানবজমিন