ডেস্ক রির্পোট:- দেশে মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ভিন্ন ভিন্ন মৌসুমে। এর মধ্যে এখন সারা বছরই ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। দেশের তিন পার্বত্য জেলায় ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। আর ডেঙ্গু এখন সারা দেশেই বিস্তার লাভ করেছে। এর সঙ্গে কিছু সংখ্যক চিকুনগুনিয়া এবং জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীও মিলছে। চিকিৎসকরা লক্ষণ দেখামাত্রই চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এসব রোগে আক্রান্ত হলে লক্ষণ কেমন হয়, আসুন জেনে নিই।
স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এসব রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জানিয়েছে।
ডেঙ্গু
ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে। এই ভাইরাসবাহী এডিস ইজিপটাই নামের মশার কামড়ে মূলত ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনও ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের (৩-১৩ ক্ষেত্রে) মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন।
এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনও জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। ডেঙ্গু ভাইরাস চার ধরনের হয়। তাই ডেঙ্গু জ্বরও একাধিকবার হতে পারে। তবে যারা আগেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে রোগটি হলে সেটি মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
১. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে, বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় হাড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেকবোন ফিভার’। জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়। যাকে বলা হয় স্কিন র্যাশ, অনেকটা অ্যালার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করেন এবং রুচি কমে যায়।
২. ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর হলে এই অবস্থাটা সবচেয়ে জটিল। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরও যে সমস্যাগুলো হয় তার মধ্যে আছে— শরীরে বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। অনেক সময় বুকে ও পেটে পানি আসার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস এবং কিডনি আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিওরের (কিডনি বিকল) মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।
৩. ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিওর (রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয়ে বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো) হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো—রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া, নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হওয়া, শরীরের হাত-পা ও অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া। এছাড়া হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে, এমনকি মৃত্যু হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে, হঠাৎ ১০৪-১০৫ ডিগ্রি জ্বর সঙ্গে মাথাব্যথা। চোখে বা চোখের পেছনে ব্যথা বা আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা হওয়া। মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়া। শরীরের চামড়ায় লালচে ছোপ বা র্যাশ ওঠা। বমিভাব, বমি হওয়া ও খাওয়ার অরুচি হওয়া। ব্রাশ করতে গিয়ে মুখ ও দাঁতের গোড়া এবং নাক দিয়ে রক্ত পড়া , ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হওয়া। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে জ্বর সেরে যাওয়া। প্ল্যাটিলেট কমে যাওয়া।
ম্যালেরিয়া
ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় দেশের তিন পার্বত্য জেলায়। তবে এই বছর ঢাকাতেও ম্যালেরিয়াবাহী অ্যানোফিলিস মশার অস্তিত্ব মিলেছে। বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হলো ম্যালেরিয়া। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায়।
ম্যালেরিয়ায় নির্দিষ্ট সময় পর পর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা এ রোগের প্রধান লক্ষণ। জ্বর সাধারণত ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বর আসা-যাওয়া করে। যেমন- একদিন পর পর জ্বর, তা ৩-৪ দিন দীর্ঘ হওয়া এবং এরপর ঘাম দিয়ে জ্বর কমে যায়। জ্বর ছেড়ে গেলে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে পারে।
এ ছাড়াও মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত অনুভব, গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, মাথাব্যথা, অনিদ্রা দেখা দেয়। অত্যধিক ঘাম হওয়া, খিঁচুনি, পিপাসা লাগা, ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করা, মাংসপেশি, তলপেটে ব্যথা অনুভব, প্লীহা ও যকৃত বড় হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। ম্যালেরিয়া হলে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হওয়ার কারণে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। ম্যালেরিয়া রোগের জটিলতম ধরন হলো ‘ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া’। সাধারণ ম্যালেরিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। যেমন- রক্তশূন্যতা, কিডনি বৈকল্য, শ্বাসকষ্ট হওয়া, জন্ডিস, খিঁচুনি, রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়। জরুরি চিকিৎসা না পেলে এসব রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
চিকুনগুনিয়া
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসজনিত রোগ। মশার মাধ্যমে এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়ায়। রোগীর শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়ায় এই রোগের এমন নাম হয়েছে বলে জানা গেছে। ডেঙ্গুর সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার লক্ষণের অনেকাংশে মিল আছে। এজন্য অনেক সময় লক্ষণ দেখেও আলাদা করা যায় না।
চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস বাহক মশা কামড়ানোর ৪ থেকে ৭ দিনের মধ্যে দেহে চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ দেখা যায়। এটি হলে সাধারণত হঠাৎ করে তীব্র জ্বর দেখা দেয়, যা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে শরীরের অস্থিসন্ধিতেও ব্যথা অনুভূত হয়। এছাড়া চিকুনগুনিয়ার আর যেসব লক্ষণ দেখা যায়, তার মধ্যে রয়েছে মাংসপেশি ও মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, ক্লান্তি ও চামড়ায় ফুসকুড়ি। অস্থিসন্ধির ব্যথা খুব তীব্র হতে পারে—যা কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
বেশিরভাগ চিকুনগুনিয়া রোগীই পুরোপুরি সেরে ওঠেন। তবে অস্থিসন্ধির ব্যথা কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ারও খবর পাওয়া যায়। কিছু ক্ষেত্রে চোখ, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র ও গ্যাস্ট্রোইন্টেসটাইনাল সমস্যার ঘটনাও ঘটে। চিকুনগুনিয়া জটিল রূপ ধারণ করার ঘটনা খুব একটা দেখা যায় না, তবে বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এটি মৃত্যুর কারণও হতে পারে। আক্রান্তের শরীরে উপসর্গগুলো তীব্র না হওয়ায় অনেক সময় রোগ শনাক্ত করতে সমস্যা হয়, যা থেকে বিপদের আশঙ্কা থাকে।
খুব কম ক্ষেত্রেই চিকুনগুনিয়া মৃত্যুর কারণ হয়। সাধারণত দুই থেকে তিন দিনেই রোগী সুস্থ হতে শুরু করে। আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে পাঁচ থেকে সাত দিন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস থাকে। এ সময়ের মধ্যে রোগীকে মশা কামড়ালে সেটিও ভাইরাসে আক্রান্ত হয় ও ভাইরাসটি ছড়ায়।
জিকা ভাইরাস
সম্প্রতি আলোচনা হচ্ছে জিকা ভাইরাস নিয়ে। ঢাকায় এডিস মশাবাহিত জিকা ভাইরাস রোগী পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। গত তিন মাসে ঢাকায় জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত অন্তত ৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত বছরও ৫ জনের জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। ২০১৪ সালে প্রথম দেশে জিকা ভাইরাসের রোগী পাওয়া যায়। এ জন্য রোগটি নতুন কিছু না। কিন্তু যেহেতু পরীক্ষা করা হয় না তাই এটি শনাক্তও হয় না।
জিকা ভাইরাস সংক্রমণ একটি ভাইরাস জনিত সংক্রামক ব্যাধি। বর্তমানে নতুনভাবে বিস্তার লাভ করা এ রোগটি ১৯৪৭ সালে প্রথম উগান্ডার জিকা নামক বনাঞ্চলের বানরের মধ্যে শনাক্ত হয়। ১৯৫২ সালে উগান্ডা ও তানজানিয়ায় মানুষের মাঝে প্রথম এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো এটি প্রধানত এডিস মশা বাহিত রোগ।
সাধারণত শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের মধ্যে রোগের কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। অন্যান্য ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার তিন থেকে ১২ দিনের মধ্যে উপসর্গগুলো দেখা যায় এবং সেগুলো ২-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বেশির সময় এ রোগটি নিজে নিজে ভালো হয়ে যায়। জিকা আক্রান্ত কোনও দেশ থেকে ফিরে আসার ১৪ দিনের মধ্যে স্বল্পমাত্রার জ্বর অথবা চামড়ায় লালচে দানার মতো ছোপ (র্যাশ) এবং এর সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ লাল হওয়া (চোখের প্রদাহ), মাংসপেশিতে ব্যথা, গিটে গিটে ব্যথার মতো যেকোনও একটি উপসর্গ দেখা দিলে জিকা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
জিকা ভাইরাস সংক্রমণের জটিলতা বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে গর্ভাবস্থায় মায়ের জিকা ভাইরাস সংক্রমণ হলে শিশুদের জন্মগত রোগ মাইক্রোসেফালি অর্থাৎ মস্তিষ্ক ও মাথার আকার তুলনামূলক ছোট হবার আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও খুবই অল্প ক্ষেত্রে স্নায়ুর অবশজনিত রোগ গিলেন-বারি সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রোগ নির্ণয় জিকা আক্রান্ত কোনও দেশ থেকে ফিরে আসার পর উপরোল্লিখিত উপসর্গগুলো দেখা দিলে, ওই ব্যক্তির জিকা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। উপসর্গগুলো শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে জিকা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে ভাইরাসটি পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। এছাড়া এক মাসের মধ্যে রোগীর প্রস্রাব এবং দুই মাস পর্যন্ত পুরুষ রোগীর বীর্য পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগ নির্ণয় করা যায়।