৯ বছরে পাঁচ খসড়া, তবু নেই আর নেই,স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৪৫ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অপ্রীতিকর ঘটনা নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অবহেলা, ভুল চিকিৎসা ইত্যাদি অভিযোগে হাসপাতাল ভাঙচুর, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু নির্দিষ্ট আইন না থাকায় সমস্যা সমাধানে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষায় ২০১৫ সাল থেকে আইন প্রণয়ের চেষ্টা চলছে। বিগত সরকারের সময় চারবার খসড়া প্রণয়ন হলেও তা পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষার অধ্যাদেশ ২০২৪’-এর খসড়া মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব উম্মে হাবিবা চলতি মাসের ১৩ তারিখে খসড়া অধ্যাদেশটি ওয়েবসাইটি প্রকাশ করা হয়েছে বলে এক চিঠিতে জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের খসড়াগুলোর মতো এবারও সুস্পষ্টভাবে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করেছে সরকার। কমিশনের সুপারিশ নিয়ে অধ্যাদেশ প্রণয়ন যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছেন তারা।

দেশের সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালিত হচ্ছিল ১৯৮২ সালের ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেজ্যুলেশন) অর্ডিন্যান্স’-এর মাধ্যমে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সামরিক ফরমানবলে জারি করা অধ্যাদেশগুলো অনুমোদন ও সমর্থন-সংক্রান্ত চতুর্থ তপশিলের ১৯ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হয়। ফলে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সেবাগ্রহীতার সুরক্ষা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিতে যুগোপযোগী আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনকে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, এই খসড়া আইনটি ভালোভাবে পর্যালোচনা করার জন্য। অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফরমস বাংলাদেশসহ (এএইচআরবি) বিভিন্ন সংগঠন থেকে যেসব মতামত দেওয়া হয়েছিল, তার প্রতিফলন তেমনটি হয়েছে কি না, তা বিশ্লেষণের অনুরোধ জানান তিনি। তা ছাড়া, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ দেবে, আইনটিতে তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন থাকা বাঞ্ছনীয়। তাই অধ্যাদেশটি কমিশনের রিপোর্ট প্রদানের আগে পাস হলে ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মতো অবস্থা দাঁড়াবে।

স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০২৩-এর খসড়ায় প্রণয়ন হলে চিকিৎসক সমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কোনো অধিকার বা দাবির যথাযথ প্রতিফলন সেখানে নেই। পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন-২০২৪-এর খসড়া প্রকাশ করা হয়। এ খসড়া আইনের বিষয়ে চলতি বছরের ২৭ জুলাই সভা হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২৬ জুলাই সভাটি স্থগিত করে।

অধ্যাদেশের খসড়া বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সামান্য অংশ নিবন্ধিত অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার আওতায় সেবা নেন। বেশিরভাগ মানুষ এখনো নিয়ন্ত্রণহীন, নিবন্ধনহীন হাতুড়ে চিকিৎসা, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ঝাড়ফুঁকনির্ভর। অথচ জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা একটি সামগ্রিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় আনা ছিল প্রত্যাশিত, যা খসড়ায় আইনে বিবেচিত হয়নি।

খসড়ার কোনো ধারায়ই প্রান্তিক মানুষের হাসপাতালে শয্যাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়নি। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা, ওষুধ, সঠিক পথ্যেরও নেই কোনো নির্দেশনা। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, দুর্ঘটনা, দুর্যোগকালে, ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়কালে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির কোনো সুরক্ষারও উল্লেখ নেই। বিশেষায়িত সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানে বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার্ড রোগীর চিকিৎসা ও সেবাপ্রাপ্তির সুরক্ষাও নেই কোনো ধারায়। নেই মেডিকেল পর্যবেক্ষণের সুবিধাসহ তার পরিবহন সুরক্ষার ব্যবস্থা। টিস্যু সংরক্ষণ, জেনেটিক উপকরণ সংরক্ষণ, পারসোনাল ডাটা সংরক্ষণ ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ও খসড়ায় আসেনি। খসড়ায় অটিস্টিক, প্রতিবন্ধী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর চিকিৎসা ও সামাজিকীকরণের কোনো প্রত্যাশা বা দায়বদ্ধতার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পৃথককরণ ও স্তরবিন্যাসের কোনো প্রক্রিয়া উল্লেখ করা হয়নি। ফলোআপ সুচিকিৎসার একটি অন্যতম অংশ; কিন্তু এ খসড়ায় রোগীর ফলোআপ-সংক্রান্ত বিষয়েও নির্দেশনা নেই। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের আবাসন, জরুরি ক্ষেত্রে পরিবহনের উল্লেখ নেই, অথচ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এই দুই অপরিহার্যতা উপেক্ষার সুযোগ নেই।

স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাত যে উপেক্ষিত এবং অবহেলিত সেটা প্রমাণিত। নয় বছর ধরে একটি আইন প্রণয়নের নামে দেশে নাটক চলছে। কারণ, যারা আইন প্রণয়ন করেন বা দায়িত্বে থাকেন, তারা কেউই দেশে চিকিৎসা নেন না। এজন্যই ২০১৫, ২০১৮, ২০২৩, ২০২৪-এ আইন প্রণয়নে স্থবিরতা দেখা গেছে। তা ছাড়া আইনে কোনো বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না দিয়ে ‘প্রণয়ন করা হইবে, বাস্তবায়ন করিতে পারিবে, নির্ধারণ করিতে পারিবে, ন্যস্ত করা যাইবে’ ইত্যাদি আইনি দুর্বলতাই প্রকাশ করে।

জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম বলেন, আইনে কার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে সেটিই বিচার্য। চিকিৎসকের অবহেলায় রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রতিকার কোথায় পাবেন? করপোরেটদের প্ররোচনায় চিকিৎসকদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা এবং ওষুধ লেখার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সেদিকেও আইনে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

বেসরকারি হাসপাতাল: কোনো বেসরকারি হাসপাতাল এ আইন বা লাইসেন্সের কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে লাইসেন্স বাতিল হবে, তবে তা করার আগে লাইসেন্স গ্রহণকারীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে; ২. লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরও ১৫ দিন সময় বাড়ানো যাবে। ৩. লাইসেন্স বাতিল হলে ওই সময়ে চিকিৎসাধীন রোগীকে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনতিবিলম্বে অন্য কোনো উপযুক্ত হাসপাতালে নিজ দায়িত্বে স্থানান্তর করবে। সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি বেসরকারি হাসপাতালের জন্য প্রদত্ত সেবার ফি ও রোগ

পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি পৃথকভাবে নির্ধারণ করবে। ফি বা মূল্য তালিকা হাসপাতাল বা চেম্বারের দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে। আদায়কৃত ফির রসিদ সেবাগ্রহীতাকে প্রদান করে তার অনুলিপি সংরক্ষণ করতে হবে।

সরকারি বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় চাকরিরত বা সেবা প্রদানকারী ব্যক্তি নির্ধারিত অফিস সময়ে কোনো ব্যক্তিগত চেম্বারে বা বেসরকারি হাসপাতালে সেবা প্রদান করতে পারবেন না। দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনকালে কোনো বেসরকারি ক্লিনিকে বা চেম্বারে সেবা প্রদান করলে কর্মচারী আইন-২০১৮ অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে। কোনো ব্যক্তি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে জড়িতদের আঘাত করবেন না, হুমকি দেবেন না বা ভীতি প্রদর্শন করবেন না। কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আত্মীয়স্বজন অনুপস্থিত থাকলে বা রোগীর জীবন গুরুতর সংকটাপন্ন হলে পরিবারের সম্মতি ছাড়াই চিকিৎসা দিতে পারবেন চিকিৎসক। সেবায় অবহেলা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, নির্ধারিত প্রটোকল অনুসরণ না করা, ভুল অঙ্গ অপসারণ, অতিরঞ্জিত রিপোর্ট করা, মাদকাসক্ত অবস্থায় চিকিৎসা দেওয়া, নার্স-আয়া-ওয়ার্ড বয় দিয়ে চিকিৎসা করানো ইত্যাদি।

অধ্যাদেশের সপ্তম অধ্যায়ে দরিদ্র, প্রতিবন্ধী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হ্রাসকৃত মূল্যে চিকিৎসা প্রদানের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো হাসপাতালে জরুরি বিভাগ না থাকলে ৫ লাখ টাকা জরিমানা, কোনো কর্মকর্তা হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হলে বাধাপ্রদানকারী ব্যক্তিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।কালবেলা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions