ডেস্ক রির্পোট:- জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় জড়িত থাকার মামলায় আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও তাদের দোসরদের বিচার শুরু হয়েছে। গত ১৮ নভেম্বর ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের ৯ মন্ত্রী ও তাদের কয়েকজন দোসরসহ মোট ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা ৪৬ জনের মধ্যে প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাদের ট্রাইব্যুনালে তোলা হল। আইন করে যে ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাজা বাস্তবায়ন করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের তৈরি সেই একই আইনে একই ট্রাইব্যুনালে এবার বিচারের জন্য তোলা হলো তখনকার আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে। এ ছাড়া এক এক করে তিনটি আলাদা প্রিজনভ্যানে আনা হয় সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম মানিক, সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং সাবেক বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে। অন্যদের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে আনা হয় আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান, ডা. দীপু মনি, শাজাহান খান, গাজী গোলাম দস্তগীর ও পলকসহ মোট ৯ মন্ত্রীকে। হাজির করা হয় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকেও।
ওইদিন সাক্ষী হতে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধে অন্যায়ভাবে সাজা দেওয়া মরহুম আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি নির্লজ্জ, অহংকারী জালিমের দল। তারা অপরাধ করে কখনো ভুল স্বীকার করে না। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় আওয়ামী লীগ বারবার গণহত্যা করেও কখনো ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। তারা ক্ষমতায় এসেই ২০০৯ সালে পিলখানায় ৫৭ জন চৌকস আর্মি অফিসারসহ আরও অনেককে হত্যা করেছে। ২০১৩ সালে ৫ মে শাপলা চত্বরে গণহত্যা করেছে। এর আগে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাজা দেওয়ার প্রতিবাদে মিছিল বের হলে তাদেরকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ওই সময় টানা তিন মাসের আন্দোলনে তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছে তা বিশ্বে নজিরবিহীন। শুধু শেখ হাসিনা যে গণহত্যাকারী তাই নয়, তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানও ৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে গণহত্যা চালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ শিকদারসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। কিন্তু এ দলটি কখনো তাদের এই সব জঘন্যতম অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি। তাদের মধ্যে এ জন্য কোন অনুশোচনাও নেই। তাই মাসুদ সাঈদী আওয়ামী লীগের অহংকারী নেতাদের ও তাদের দোসরদের ন্যায় বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন।
বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারানোর সাড়ে তিন মাস পরেও নিজেদের কৃতকর্মের বিষয়ে আওয়ামী লীগে কোনো অনুশোচনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং পুরো বিষয়টিকে এখনো ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবেই মনে করে দলটি। বিশেষ করে, গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলন দমনে যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে এবং তাতে যত প্রাণহানি হয়েছে, সেটির দায় স্বীকার করে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি দলটিকে। দলটির শীর্ষ নেতারা এখনও বিশ্বাস করেন যে, গণঅভ্যুত্থানের নামে ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের’ মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। একই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন নেতারা। আর এই মনোভাবের কারণেই তাদের পালিয়ে যাওয়া নেত্রীর বিদেশে বসে এখনো হুমকি ধামকি দিচ্ছে। তার যে কোন অনুশোচনা নেই তার কর্মকাণ্ডে সেটা প্রকাশ পাচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ভারতে পালিয়ে গিয়েও সেখান থেকে ভারতের মদদে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে। ভারতের আশ্রয়ে থেকে শেখ হাসিনা টেলিফোনে দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলছে এবং নিজেই সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। ১৮ নভেম্বর শেখ হাসিনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার নির্দেশনা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুর্বল নীতির কারণে মূলত শেখ হাসিনা এমন ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নেটিজেনরা বলছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক চ্যানেলে ‘শেখ হাসিনার দেশবিরোধী বক্তব্য’ বন্ধে কঠোর বার্তা দিল্লিকে না দেয়ায় হাসিনা একের পর এক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তার লোকজনকে উসকানি দিয়েই যাচ্ছে। শেখ হাসিনা তার দিল্লির প্রভুদের আসকারায় ক্রমান্বয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। ক’দিন পরপরই হাসিনা দলের বিভিন্ন জনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছেন এবং সেই অডিও কল রেকর্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফোনে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় তাকে। সেখানে ছুড়ে দিচ্ছে নানা হুমকিও। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও হুমকি দিচ্ছে। এতেই বোঝা যায় যে দাম্ভিক ও অহংকারী জালিম হাসিনার প্রায় এক হাজার ছাত্র জনতাকে হত্যা করার কোন অনুশোচনা নেই। জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়াতো দূরের কথা এখনো সে হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে তার মতো তার সরকারের মন্ত্রী এমপি ও অন্যান্য দোসদের আচার আচরণও তার মতোই ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তাদের মধ্যেও কোন অনুশোচনা নেই। গত ১৮ নভেম্বর যাদেরকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় তাদের দেখে মনে হয়েছে তারা যেন কোন পাঁচতারা হোটেল থেকে এখানে বেড়াতে এসেছেন। তাদের অনেকের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, হাত নেড়ে অভিবাদন জানানো, ভি চিহ্ন প্রদর্শন এসবই তাদের দাম্ভিকতার বহিঃপ্রকাশ। সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা তাদের হাতে কোন হ্যান্ডকাপ নেই। বীরদর্পে তারা হেঁটে যাচ্ছে। আয়না ঘরের কারিগর হিসাবে পরিচিত সেই জিয়াউল হাসানকে পুলিশের সাথে খারাপ আচরণ করতেও দেখা গেছে। তাদের আচার আচরণে মনে হচ্ছে এখানে তাদের কিছুই হবে না। কিছুদিনের জন্য হয়তো তারা এখানে পাঁচতারকা হোটেলের আরাম আয়েশ ভোগ করে পরে আবার বেরিয়ে যাবেন এবং ক্ষমতায় বসবেন। টিভি পর্দায় মন্ত্রী ও নেতাদের এমন হাস্যোজ্জ্বল অবস্থা দেখে সাধারণ মানুষ বেশ অবাক হয়েছেন। অনেকে মন্তব্য করছেন, ‘কি বেহায়া বেশরম ওরা। এত অন্যায় অপরাধ করেও তাদের কোন অপরাধ বোধ নেই। তাদের কোন অনুশোচনা নেই।’
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় বলেন, আওয়ামী লীগের কোনো অপরাধবোধ নেই। গণহত্যা আর অপরাধের বিষয়ে তাদের মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনাবোধও নেই। ক্ষমা চাওয়ার লক্ষণ নেই। উলটো পুলিশ হত্যার বিষয়টিকে সামনে এনে তারা গণহত্যার অপরাধের বাইরে আলাদা বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় দেশের মাটিতে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার হতেই হবে। শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। এ বিষয়ে সরকার ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। যাদের হাতে শহীদদের রক্ত, যারা মানুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন ও খুন করেছে, তাদের বিচার হতেই হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ যে গণহত্যা চালিয়েছে সে জন্য এখনো তারা জাতির কাছে অনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। তাদের মধ্যে কোন অপরাধবোধ নেই। এখনো ষড়যন্ত্র করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা চলছে। অনেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে। তারা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়। সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের কোন ক্ষমা নেই, তাদের বিচার হতেই হবে। ইনকিলাব