ডেস্ক রির্পোট:- সপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জনমনে এ ঘটনার ধাক্কার রেশ না কাটতেই ১৬ নভেম্বর রাজধানীতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে দুই ভাই শিশু রোহান (৭) ও মুসা (৩)। হত্যাকারী তাদেরই বাবা।
দেশে গত আট বছরে যে ৪ হাজারের বেশি শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তারই সাম্প্রতিকতম নজির মুনতাহা, রোহান, মুসারা। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ বছরে অন্তত ৪ হাজার ৩৮০ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এর সঙ্গে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসের পরিসংখ্যান যুক্ত করলে সংখ্যাটা আরও ৪৮২ জন বাড়বে।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ ২০ নভেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে সর্বজনীন শিশু দিবস বা বিশ্ব শিশু দিবস। ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এর পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন প্রতিবছর এই দিবস পালন করে থাকে।
মূলত মানবাধিকার ও আইন বিষয়ে কাজ করা সংগঠন আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই আট বছরে সহিংসতার শিকার হয়েছে ১০ হাজার ৪১ শিশু। আসক বলছে, শিশু হত্যা এবং তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। কারণ, তাদের পরিসংখ্যানে শুধু দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনাগুলোই উঠে আসে। এর বাইরে শিশু হত্যা ও নির্যাতনের বহু ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায়।
আসকের চেয়ারপারসন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক আইন আছে। অনেক কিছু আছে; কিন্তু আমরা শিশুদের জন্য নিরাপদ সমাজ, নিরাপদ রাষ্ট্র দিতে পারছি না।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিশু হত্যা ও সহিংসতার ঘটনায় মামলা হয় অনেক কম। যেসব মামলা হয়, সেগুলোতেও বিচার ও সাজার নজির কম। অনেক ক্ষেত্রে মামলায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধী পার পেয়ে যায়।
পরিসংখ্যান বলছে, এই আট বছরে ৪ হাজার ৩৮০ শিশু হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৭৪৫টি। আর ১০ হাজার ৪১ শিশুর সহিংসতার শিকার হওয়ার ঘটনার বিপরীতে মামলা হয়েছে ৫ হাজার ৭২টি। অর্থাৎ প্রাণহানি না ঘটলে মামলা করার প্রবণতা তুলনামূলক অনেক কম।
‘উই ক্যান’ জোটের সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বলেন, শিশু হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে নিজের পরিবারের সদস্যরা জড়িত থাকে। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে মামলা হয় না।
আসকের সমন্বয়ক তামান্না হক রীতি বলেন, ‘বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করে। তবে শিশু অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার আরও পুরোনো। এই সনদে স্বাক্ষরের বহু আগে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে শিশু অধিকার আইন প্রণীত হয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, এত বছরেও আমরা শিশুদের নিরাপত্তা এবং অধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি।’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের গত তিন মাসে শিশু অধিকারের বিষয়টি তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিত রয়েছে বলে মনে করেন কোনো কোনো শিশু অধিকারকর্মী। এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটি শিশু ও কিশোর-কিশোরীর জন্য সহিংসতামুক্ত, সুরক্ষিত পরিবেশ গড়ে তুলতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং মা-বাবাকে সম্পৃক্ত করে কাজের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’