বাবা মাইরো না—দুই সন্তানের আর্তচিৎকারেও মন গলেনি পাষান বাবার

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৬ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- ‘বাবা মাইরো না, মাইরো না বাবা। আর করব না। আর করব না।’ আর্তচিৎকার করেও বাবা আহাদ মোল্লার হাত থেকে রক্ষা পায়নি তিন বছরের শিশু মুসা। এর আগে মুসার বড় ভাই সাত বছরের শিশু রোহানকেও গলা কেটে হত্যা করেন বাবা। দুই সন্তানকে হত্যার পর নিজের গলায়ও ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি।

গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পল্লবীর বাইগারটেক নামক এলাকার ব্যাপারী মার্কেটের পাশের একটি তিনতলা বাড়ির নিচতলায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।

নিহত দুই শিশু হলো—রোহান মোল্লা বিজয় (৭) ও মুসা মোল্লা (৩)। তাদের বাবা আহাদ মোল্লা বাসাবাড়ির নিরাপত্তাকর্মী এবং মা রোজিনা আক্তার মেসে রান্নার কাজ করেন। বাবা আহাদ মোল্লাকে গুরুতর আহত অবস্থায় দুই সন্তানের মৃতদেহের পাশ থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ঘটনাস্থল রাজধানীর পল্লবীর শেষ সীমানা বাইগারটেক। অনুন্নত এই এলাকায় এখনো জনবসতি কম। নতুন নতুন বাড়ির নির্মাণকাজ চলছে। রাস্তাঘাট চলার অনুপযোগী। ইসিবি চত্বর দিয়ে বালুঘাট ছাড়িয়ে উত্তরের আরও তিন-চার কিলোমিটার সরু রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগুলো বাইগারটেক। এর আগে ব্যাপারী মার্কেট। এই মার্কেটের পাশেই নাসির হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীর ছোট্ট তিনতলা বাড়ি। বাড়ির নিচতলার দুটি কক্ষে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন আহাদ মোল্লা। সেখানেই দুই সন্তানকে তিনি হত্যা করেন।

সরেজমিন দুপুরে বাইগারটেক গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িটি ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভিড়। চারপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে মানুষ। তবে পুলিশ কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ইউনিট আলামত সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। মানুষের ভিড় ঠেলে বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, দুই কক্ষের বাসাটির সামনের কক্ষের একটি খাটে দুই সন্তান হারিয়ে নির্বাক মা রোজিনা আক্তার বসে আছেন। তাঁর দুপাশে বৃদ্ধ বাবা ও মা বসা। তাঁরা গত সোমবার মেয়ের বাসায় বেড়াতে আসেন। এই বৃদ্ধ বাবা–মা তাঁর মেয়েকে সন্তান হারানোর সান্ত্বনা দিচ্ছেন, তবে তাঁরাও বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। কেন হলো এমন, কেউ কিছু বুঝতে পারছেন না। কারও কাছে কোনো উত্তর নেই। অপর কক্ষে খাটের ওপর পরে আছে রক্তাক্ত বিছানা, বালিশ ও একটি ছুরি।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিহত দুই সন্তানের মা রোজিনা আক্তার বলেন, ‘শনিবার ভোরে তাঁর স্বামী আহাদ মোল্লা কাজ থেকে বাসায় ফেরেন। প্রতিদিনের মতো আজও সকাল ৯টার দিকে রোজিনা তাঁর বেড়াতে আসা বৃদ্ধ মাকে নিয়ে মেসে রান্নার কাজে রওনা দেন। এ সময় তাঁর স্বামী দুই ছেলেকে বাসায় রেখে যেতে বলেন। প্রতিদিন মেসে দুই ছেলেকে নিয়ে গেলেও স্বামীর অনুরোধে এবং তাঁর নানা বাসায় আছেন ভেবে ছেলেদের বাসায় রেখে যান। মেসে পৌঁছানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাঁর কাছে দুই ছেলে মারা গেছে এমন ফোন আসে। এরপর তিনি বাসায় দৌড়ে আসেন। পরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।’

ঘটনার সময় শিশুদের সত্তরোর্ধ্ব নানা জাবেদ আলী পাশের কক্ষেই ছিলেন। তিনি সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না। বেশিক্ষণ বসেও থাকতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘পাশের কক্ষেই দুই সন্তান নিয়ে ছিল আহাদ। আমি কেবল কান্নার শব্দ পেলাম। ছোট ছেলে কান্না করে বলছিল, বাবা মাইরো না, বাবা মাইরো না। আর করব না।’ তিনি তখনো বুঝতে পারেননি, আহাদ তাঁর ছেলেদের হত্যা করছে। অসুস্থ জাবেদ আলী বিছানা থেকে উঠে যেতে তিন মিনিটের মতো সময় লেগেছে। তিনি গিয়ে দেখেন, দুই নাতিকে গলা কেটে বিছানায় ফেলে রেখেছে, আহাদ নিজেও বিছানায় শোয়া, রক্তাক্ত। এরপর তিনি হামাগুড়ি দিয়ে চিৎকার করে রাস্তায় আসেন। মানুষজন ডাকেন। স্থানীয়রা গিয়ে এই অবস্থা দেখে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ গিয়ে দুপুরে লাশ উদ্ধার করে।

বাবা আহাদ মোল্লার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর। তাঁর স্ত্রী রোজীনা বেগমের বাড়ি নেত্রকোনা। আহাদের এটি তৃতীয় এবং রোজিনার দ্বিতীয় বিয়ে।

দুই সন্তানকে হত্যার বিষয়ে রোজিনা বলেন, ‘আহাদ অনেক টাকা ঋণগ্রস্ত ছিল। সে প্রায়ই আমার কাছে টাকা চাইত, তবে আমার কাছে এত টাকা ছিল না। ঋণের কারণে সে ছেলেদের হত্যা করতে পারে। পাওনাদারেরা চাপ দিলেও সে ঘরে টাকা চাইত।’ তবে দুই-এক দিনে কোনো ঝগড়া হয়নি। কোনো ঝামেলাও হয়নি বলে জানান রোজিনা আক্তার।

সন্তানদের হত্যার আগে বাসার পাশের দোকান থেকে রুটি ও জুস নিয়েও খাওয়ান আহাদ। প্রতিবেশী তাহমিনা নামে এক নারী বলেন, ‘সন্তানদের খুব ভালোবাসতেন তিনি। কখনো মারধর করতে দেখেননি।’

দুই মাস ধরে বাড়িটিতে ভাড়া আছেন আহাদ-রোজিনা দম্পতি। বাড়িওয়ালা নাসির বলেন, ‘আহাদ তিনটা বিয়ে করেছে, তার পারিবারিক সমস্যা রয়েছে বলে জেনেছি। তবে কেন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা জানা যায়নি।’

গুরুতর আহত আহাদ বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগে ভর্তি আছেন। ওই বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক শেখ আব্দুল্লাহ মামুন বলেন, ‘আহাদের শ্বাসনালি কেটে গেছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। পুলিশ পাহারায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’

দুই শিশুর মরদেহ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েছে পল্লবী থানা-পুলিশ।

পল্লবীর ওসি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের কারণ এখনো জানা যায়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তি গুরুতর আহত। তিনি সুস্থ হলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নিহত শিশুদের মা রোজিনা এই ঘটনায় মামলা করেছেন।আজকের পত্রিকা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions