আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণই ‘বিশাল চ্যালেঞ্জ’

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৫০ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- গত ৮ আগস্ট শপথ নেওয়ার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে গতকাল ১৫ নভেম্বর। সরকারের এই সময়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন-পরবর্তী সময়ে পুলিশের অনুপস্থিতিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে অপরাধীরা।

আইন-শৃঙ্খলাই বিশাল চ্যালেঞ্জ৮ আগস্ট থেকে গতকাল শুক্রবার (১৫ আগস্ট) পর্যন্ত দেশে সহিংসতার ঘটনায় কয়েক শ মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

এর মধ্যে গত তিন মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ৬৮ জন। পুলিশ, হাসপাতাল, মানবাধিকার সংগঠন ও নিহতদের পারিবারিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এর মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সামাজিক বিরোধে আগস্টে ৫৪১ জন, সেপ্টেম্বরে ৮৪ জন, অক্টোবরে ৯১ জন ও নভেম্বরের গত ১৫ দিনে আরো অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আর্থ-সামাজিক ও মনোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এসব অপরাধ বাড়ছে।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা, সহিংসতার এসব ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশে প্রায় প্রতিদিন সামাজিক নানা কারণে হত্যার ঘটনা ঘটছে। কিছু ক্ষেত্রে এসব সহিংসতার ঘটনায় বলি হচ্ছে নারী ও শিশুরা।

সর্বশেষ গতকাল সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর আজিমপুরে এক বাসায় প্রবেশ করে ডাকাতরা মালপত্রসহ ওই বাসা থেকে একটি শিশুকেও নিয়ে যায়।
একই দিনে চট্টগ্রামে এলোপাতাড়ি গুলিতে ১৫ জন আহত হয়েছে। আর দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক হত্যার তথ্য পাওয়া গেছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে পুলিশ তৎপর থাকলেও এসব ঘটনা থেকে পুলিশও রেহাই পাচ্ছে না।

সম্প্রতি রাজধানীর সবচেয়ে আলোচিত বিষয় মোহাম্মদপুরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। সেখানকার বিহারী ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় অন্তত ১২ জনকে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এর বাইরে ছিনতাই, ডাকাতি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার রাত ১০টার দিকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে চৌরাস্তার দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় প্রকাশ্যে ছিনতাইকারীরা নাঈমুর রহমান নামের এক সাংবাদিকের ক্যামেরা, মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেয়। যদিও মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশেষ অভিযানের পর মোহাম্মদপুর এলাকার পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সম্প্রতি যৌথ বাহিনীর অভিযানে এই এলাকা থেকে শতাধিক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এদিকে গতকাল ভোরে রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকায় খুন হয়েছেন এ কে এম আব্দুর রশিদ নামের এক প্রবাসী চিকিৎসক। আগের দিন বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে হাজারীবাগ পার্কের পাশে ছুরি মেরে শাহাদত হোসেন শান্ত নামের এক কিশোরকে হত্যা করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রামের রাউজানে একদল মুখোশধারীর হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে অন্তত ১৫ জন। একই দিন জয়পুর হাটে দিলিপচন্দ্র নামের এক অটোচালকের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এর আগের দিন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় সবুজ নামের এক যুবকের আগুনে পুড়ে যাওয়া লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর আগে তিন দিন নিখোঁজ থাকার পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি লেক থেকে পলিথিনে মোড়ানো শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুমের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১২ নভেম্বর নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থেকে নিশাত ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

একই দিন সাভারের বিরুলিয়ায় গৃহবধূ শান্তনা বেগমকে সাত টুকরা করে হত্যা করা হয়। ১২ নভেম্বর শেরপুরে নিখোঁজের ৮ দিন পর সুমন মিয়া নামের এক কলেজছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও পার্বত্যজেলা রাঙামাটিতে সংঘর্ষ সহিংসতায় চারজন নিহত হন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশে লম্বা সময় মাঠে ছিল না পুলিশ। অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র লুটের পাশাপাশি কারাগার থেকে আসামি পলায়নের ঘটনাও ঘটে। এরপর তৈরি পোশাক কারখানায় অস্থিরতা এবং পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই ও দখলদারির ঘটনা জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। থানা থেকে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের বেশির ভাগ এখনো উদ্ধার হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, সেসব আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে। গত অক্টোবরে দেশে ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত তিন মাসে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে অন্তত ৬৮ জনকে। এ সময় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৮টি। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুরাও হামলার শিকার হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা এমএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে অন্তত ২৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছে। আগের দুই মাসে এই সংখ্যা ছিল ৬৫। সর্বশেষ নড়াইল সদরে গরু চোর সন্দেহে দুলাল ও নুরনবী নামের দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

অক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৫৮টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছে ৪২৪ জন। এর মধ্যে ১২ জন নিহত ও ৪১২ জন আহত হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৯ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। অন্য তিনজন বিএনপির। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সহিংসতার ৫৮টি ঘটনার মধ্যে ৩৭টি ঘটনা বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলজনিত, ১৭টি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব, দুটি আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলে এবং দুটি ঘটনা ঘটেছে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দ্বন্দ্বে।

অক্টোবর মাসে ৫৩টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ পাওয়া গেছে। সেপ্টেম্বর মাসে এই সংখ্যা ছিল ৪৯। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২৩টি।

বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ প্রতি মাসে মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, অবৈধ অস্ত্রে হানাহানির প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে যৌথ বাহিনী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান শুরু করে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ৩১৮টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এই সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৭৪ জন সন্ত্রাসীকে।

বিপাকে পুলিশ

গতকাল সকাল ১০টার দিকে আজিমপুরে এক সরকারি কর্মকর্তার বাসায় মালপত্রের সঙ্গে একটি শিশুকেও নিয়ে গেছে ডাকাতরা। সকাল, দুপুর, রাত কিংবা ভোর, সার্বক্ষণিক রাজধানীসহ সারা দেশে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। ভুক্তভোগীরা বলছে, ছিনতাই প্রতিরোধে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। যদিও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে রাজধানীর ৫০টি থানার পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি গোয়েন্দারা কাজ করছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত কয়েকটি হত্যাকাণ্ড

গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে যশোরে মাথায় গুলি করে মেহের আলী (৪৫) নামে এক প্রবাসীকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সম্প্রতি কুয়েত থেকে দেশে ফেরেন তিনি। স্থানীয় বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। স্বজনদের দাবি, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক কোন্দলে এই হত্যার ঘটনা ঘটে।

এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় ছুরিকাঘাতে মো. জিন্নাহ (৬০) নামে ব্যাটারিচালিত এক রিকশাচালক খুন হয়েছেন। ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মুনতাকিম আলিফ (২৭) নামের এক তরুণ নিহত হন। ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহাখালীতে নেশার টাকা না দেওয়ায় মশিউর রহমান (৪৫) নামের এক ব্যক্তি আপন ছোট ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছেন। ২৩ সেপ্টেম্বর বাসায় চুরি করতে গিয়ে দুই চোর নটর ডেম কলেজের অফিস সহকারী লিপিকা গোমেজকে হত্যা করে বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধবার সেনা সদরে এক ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, সম্প্রতি সেনাবাহিনী দেশে সাত শতাধিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। লুট হয়ে যাওয়া ছয় হাজার অস্ত্র, দুই লক্ষাধিক গুলি উদ্ধার করেছে এবং এতে সম্পৃক্ত আড়াই হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে।

সার্বিক বিষয়ে মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, দেশে সামাজিক নানা অস্থিরতার কারণে অপরাধমূলক ঘটনা কিছুটা বেড়েছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।

মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষক নুর খান বলেন, মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। বিশেষ করে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমে খারাপের দিকে যাচ্ছে। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। দ্রুত এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।কালেরকন্ঠ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions