ডেস্ক রির্পোট:- তিন মাস পেরোতেই চতুর্মুখী চাপে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচনের চাপ, উপদেষ্টা পরিষদে ও বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন নতুন নিয়োগ নিয়ে সমমনাদের তীব্র সমালোচনা, বিভিন্ন মহল থেকে নতুন উপদেষ্টা হওয়ার আগ্রহ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, দাবিদাওয়া নিয়ে অসন্তোষ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানান সমালোচনায় ক্রমেই চাপ বাড়ছে সরকারের ওপর। এসব ক্ষোভ-অসন্তোষ সামাল দিতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সামাল দিতে মাঝেমধ্যেই হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। পরীক্ষা না দিয়ে এইচএসসিতে কয়েক বিষয়ে ছাত্রদের অটোপাসের আন্দোলন সফল হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা যেন হালে পানি পেয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সচিবালয় এলাকায় কোনো সভাসমাবেশ নিষিদ্ধের ঘোষণা দিলেও সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঘেরাও করেছিলেন সচিবালয়। নতুন ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তর, ইউজিসি প্রস্তাবিত পাইলট প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তিসহ পাঁচ দাবি নিয়ে সোমবার এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। এ সময় তরুণ এক উপদেষ্টার উপস্থিতিতে দেওয়া স্লোগান ঘিরে তৈরি হয় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি। গতকাল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা উপদেষ্টাকে উপলক্ষ করে স্লোগান দেননি। তবে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল সরব। শুধু এ ঘটনাই নয়, নতুন নিযুক্ত দুই উপদেষ্টাকে নিয়েও সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিভিন্ন দিক থেকে। তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে হয়েছে বিক্ষোভ সমাবেশও। দেশে ও বিদেশে বসে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কর্মকাে র সমালোচনায় সরব রয়েছেন।
নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমবার বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, মশকরা হচ্ছে ছাত্রদের সঙ্গে। ছাত্রদের রক্তের ওপর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ থেকে কমপক্ষে পাঁচজনকে নিয়োগ দিতে গতকাল রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। সড়ক অবরোধের কারণে রংপুরসহ বিভাগের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল।
ক্ষোভ আছে পুরনো উপদেষ্টাদের নিয়েও। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ওপর। চিকিৎসা নিয়ে ক্রমাগত অভিযোগ করে আসা আহতরা গতকাল সামনে পান উপদেষ্টাকে। এ সময় তিনি তোপের মুখে পড়েন। আন্দোলনে আহতদের দেখতে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করেননি উপদেষ্টা। এ অভিযোগ তুলে হাসপাতাল থেকে বেরোনোর পথে তাঁর পথ আটকে বিক্ষোভ করেন আহতরা। এখনো আহতরা সবাই ১ লাখ টাকা করে পাননি অভিযোগ করেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে গুরুত্ব না দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। কারণ আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। শহীদের তালিকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েক গুণ হলেও তারা উপেক্ষিত রয়েছেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফেসবুক প্ল্যাটফরমে (প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশ-পুসাব) বলা হয়েছে, সরকার স্বেচ্ছাচারী হলে আমরা টেনে ধরব। অন্যায্য কিছু করলে অবশ্যই বিরোধিতা করব। অধিকারের ব্যাপারে আমরা আপসহীন। তারা বলেন, কে উপদেষ্টা হবেন এ সিদ্ধান্ত কারা নেন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এসব নিয়েও বড় ধরনের চাপে রয়েছে সরকার। আর রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ থেকে উপদেষ্টা নিয়োগের দাবি নিয়েও শুরু হয়েছে অসন্তোষ। এসব অসন্তোষ কাটিয়ে উঠতেও তেমন একটা পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না সরকারকে। ফলে সমালোচনা আরও ডালপালা মেলছে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি অস্থিরতা। এখনো চাপে ফেলে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা চলছে অনেক জায়গায়।
দেশে সামাজিক অপরাধ বেড়েই চলেছে। নানা উদ্যোগ নিলেও এসব সমস্যার লাগাম টানতে বেগ পেতে হচ্ছে সরকারকে। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি নিয়ে মানুষের দুর্ভোগ কমছেই না। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামে লাগাম টানতে পারছে না প্রশাসন। এ নিয়ে বড় চাপে রয়েছে সরকার। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও অক্টোবরে আবার বেড়েছে। অক্টোবরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ; যা সেপ্টেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ।
যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সরব রয়েছে বিএনপিসহ কয়েকটি সমমনা দল। যদিও সরকারের অনেক উপদেষ্টা বলছেন, ‘শুধু নির্বাচনের জন্য দেশের মানুষ জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেনি।’ তবে নির্বাচনের দাবি করা বৃহৎ দলগুলোর বক্তব্য, ‘দেশের সংস্কারের দায়িত্ব রাজনৈতিক সরকারের।’ তাই দ্রুত নির্বাচনের দাবি রয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার তৈরি করছে আরেক ধরনের চাপ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর কূটনৈতিকভাবে সরকারের ওপর নানান চাপ তৈরির কথাও প্রচার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী গতকাল বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে সরকার পরিচালনায় চাপ থাকবেই। তা ছাড়া গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ সরকার এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতাও নেই। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের মধ্যে দুজনকে নিয়ে সমালোচনা চলছে। তাঁরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে নানা সুযোগসুবিধা নিয়েছেন। তাঁদের একজন আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রচারেও অংশ নিয়েছিলেন।’
এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরও বলেন, সরকারে নিয়োগকৃত উপদেষ্টাদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের বাসিন্দা। এদের অনেকের এনজিও ব্যাকগ্রাউন্ড। তা ছাড়া কয়েকজন গ্রামীণ ব্যাংকের। তাই ‘এনজিও’ আর ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ মিলে এ সরকারকে ‘এনজিওগ্রাম সরকার’ বললে কি অন্যায় হবে? এনজিওগ্রাম সরকার দিয়ে দেশ চলতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন প্রফেসর নুরুল আমিন বেপারী। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি করেছে। এ দাবি মানেই তো দ্রুত নির্বাচন নয়। আবার দেশের নানা সংস্কারগুলোও হওয়া উচিত। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেন ভালোভাবে কাজ করতে পারে এজন্য সংস্কার হওয়া দরকার। কিন্তু সংস্কার তো একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা যাবে না। তাই সরকারের উচিত একটি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা।বাংলাদেশ প্রতিদিন