মাসুমা হক প্রিয়াংকা:- আমরা যারা সবে শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশের অপেক্ষায় আছি, আমাদের জন্য জুলাই অভ্যুত্থান কতটা আশার ঝলক নিয়ে এসেছে–ইদানীং এই প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বৈষম্যের অবসান কে না চায়? সে জন্যই সম্ভবত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে দেশের ছাত্রসমাজ। গুলির মুখে বুক উঁচু করে সবাই দাঁড়াতে পারে না।
তবে মানুষ মরতে শিখলে তাদের কেউ দাবিয়েও রাখতে পারে না। ছাত্র-তরুণেরা বারবার মরে এই মরার দেশে বরাভয় এনেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু শাসক বদলের তিন মাস যেতে না যেতেই আমার মতো অনেকের মনেই প্রশ্ন, এই যে সাহস দেখিয়ে গৌরবগাথা রচনা করা হলো তার ফলাফল কী? দেশ থেকে কি বৈষম্য দূর হচ্ছে? মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়ার পথ কি প্রশস্ত হয়েছে? দলীয় বা অন্য কোনো পরিচয়ের সূত্র কি এখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে পথের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না?
শেখ হাসিনার শাসনামলে ছাত্রলীগ একটি ঠ্যাংগারে বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে হেন কোনো অপকর্ম নেই যা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে করা হয়নি। এখন শাসক বদল হওয়ায় ছাত্রলীগের দুঃসময় চলছে।
কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কি এখন পুরোনো ছাত্রলীগের ভূমিকায় নামছে?
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শহীদ মিনারে সমাবেশ ডেকে ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। উত্থাপিত দাবির মধ্যে ছিল রাষ্ট্রপতির পদত্যাগসহ ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ প্রশ্নে মতভিন্নতা দেখা দেওয়ায় মো. সাহাবুদ্দিন এখনো বঙ্গভবনে বহাল আছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ছাত্রলীগের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দাবি করার এক দিনের মধ্যেই সরকার সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করেছে। অবশ্য নিষিদ্ধ করার আগে থেকেই অর্থাৎ সরকার পতনের পর থেকেই ছাত্রলীগের দুঃসময় চলছে। ছাত্রলীগ করতেন—এই অপরাধে কমপক্ষে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এখন নিষিদ্ধ ঘোষণার পর ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের পরিচয়ধারীদের ‘খেদানো’ অভিযান চলছে। ২৭ অক্টোবর রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজে পরীক্ষা দিতে এসে ছাত্রলীগ নেত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস প্রিয়ার হেনস্তা ও গ্রেপ্তার হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। ২৮ অক্টোবর সংবাদমাধ্যমের খবর, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ৭৫ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে, যাদের ‘বেশির ভাগই সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থক’। ২৯ অক্টোবরের খবর, ‘ছাত্রলীগ ক্যাডার’ খুঁজতে শেষ চারটি বিসিএসের (৪৩-৪৬তম) পুরো প্রক্রিয়া পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এর বাইরে, একই উদ্দেশ্যে আরও ছয়টি (২৮, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৪০ ও ৪১তম) বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আট ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাইয়ের কাজও শুরু হয়েছে। এর আগে প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর নির্ধারিত দায়িত্বের জন্য সারদা পুলিশ একাডেমিতে অপেক্ষমাণ পুলিশের ২৫২ উপপরিদর্শককে অব্যাহতি প্রদানের খবরও সবার জানা। এরা ছাত্রলীগ বলে ধারণা করা হয়েছে।
কারও বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা তথ্যপ্রমাণ ছাড়া শুধু ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার কারণে বৈষম্যমূলক আচরণ করা মোটেও ঠিক কাজ নয়। গত শাসন আমলে অনেককে যে বাধ্য হয়েও ছাত্রলীগে নাম লেখাতে হয়েছিল, সেটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অতি সোচ্চার সমন্বয়ক সারজিস আলমও তাঁর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগে নাম থাকলেই খারাপ, এমন ভাবা ঠিক নয়। ছাত্রলীগ পরিচয়ধারী, পদধারী অনেকেই কোটাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, এভাবে শত্রু খোঁজা কি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন অস্থিরতা তৈরি করবে না? ছাত্রলীগকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন যাঁরা তাঁরা ছাত্রশিবিরের ব্যাপারে চুপ কেন? ছাত্রশিবির তো কম সন্ত্রাসী সংগঠন নয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইজা মেহজাবিন মনে করেন, ‘১৯৭১ সালের গণহত্যার সহযোগী সংগঠন জামায়াত-শিবির। শেখ হাসিনার সরকারের হাতে যেমন ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতাকে খুনের দাগ আছে, তেমনি ৭১-এর গণহত্যার রক্তের দাগও জামায়াত-শিবিরের হাতে লেগে আছে। এই গণহত্যার দায় তারা অস্বীকার করতে পারে না। আশির দশকেও ছাত্রশিবির একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিকৃষ্টতম কার্যক্রম চালিয়েছে। ছাত্রশিবির অতীতে যেভাবে ক্যাম্পাসের সাধারণ মুক্তমনা শিক্ষার্থীদের রগ কেটে দমন ও প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে; এখন আবারও তারা পুনর্বাসিত হওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে।’
পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে কারও অধিকার কেড়ে নিয়ে কিংবা কাউকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বা রাষ্ট্র গঠন কি আদৌ সম্ভব? মাসুমা হক প্রিয়াংকা, সমাজকর্মী ও শিক্ষার্থী