ডেস্ক রির্পোট:- সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সিলেট জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. ফজলে রব্বে। এর আগে গাজীপুর, বরিশাল ও ঢাকায় কর্মরত ছিলেন তিনি। ওই সব এলাকায় থাকার সময় ফজলে রব্বের নানা অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। এর পরও তিনি দমে যাননি। সিলেটে এসেও কমিশন-সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঠিকাদার ও সওজের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কারকাজেও অনিয়ম করেছেন ফজলে রব্বে। এসব কিছু তিনি করেছেন তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর ভর করে। সেই সঙ্গে পদোন্নতিও বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি।
সওজ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৫ মার্চ সওজ সিলেট জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন ফজলে রব্বে। এর দুই মাস পর সিলেট বিভাগে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়। এরই মধ্যে ফজলে রব্বে সখ্য গড়ে তোলেন সিলেট নগরের সুবিদবাজার এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান ওরফে মুরগি হান্নান, গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফুর রহমানসহ কয়েকজনের সঙ্গে। হান্নান ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জে হাওর রক্ষা বাঁধে দুর্নীতির অন্যতম হোতা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার আসামি।
সওজ সূত্র জানায়, বন্যায় সওজ সিলেট জোনের অধীনে বিভাগের চার জেলার ৩৫১ দশমিক ৪৮ কিলোমিটার সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সিলেট জোনের সড়ক মেরামতকাজের জন্য ৬৩৫ কোটি ৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকার ৩১টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে কাজের মান যাচাই-বাছাই না করেই শেষ করার আগে বিল দেওয়া হয়েছে অনেক ঠিকাদারকে। ফলে সিলেটবাসীর সড়কে ভোগান্তি আজও দূর হয়নি।
৩১ প্রকল্পের একটি রশিদপুর-বিশ্বনাথ-রামপাশা-লামাকাজী সড়ক ৮ কোটি ৮৩ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে এই সড়কের ১৩ দশমিক ১৬০ কিলোমিটার সংস্কারকাজ করা হয়। সর্বোচ্চ সাত মাস মেয়াদের কাজটির কাগজপত্রে ঠিকাদার যৌথভাবে ‘মেসার্স অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা’ ও ‘তৈয়বুর রহমান’। তবে মাঠে কাজ করেন আবদুল হান্নান ওরফে মুরগি হান্নান।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ওই সড়কের ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার থেকে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় এখনো অনেক গর্ত। রাস্তার দুই পাশে মাটি ধসে পড়ায় ইট থাকছে না। অথচ ফজলে রব্বের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি (অথরাইজড পারসন) আবদুল হান্নান ৯৩ শতাংশ কাজের বিল নিয়ে গেছেন।
জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরার মালিক অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের এ রকম কোনো কাজ আছে বলে জানা নেই। তাঁকে টেন্ডার নম্বর পাঠানোর জন্য বলেন।
টেন্ডার নম্বর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হলে দেখেও আর কোনো কিছু বলেননি এবং ফোনও ধরেননি।
আরেক প্রকল্প সুনামগঞ্জের নিয়ামতপুর-তাহিরপুর সড়ক ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ৮৫ হাজার ৯৫০ টাকা ব্যয়ে সড়কটির ৯ কিলোমিটার সংস্কারকাজ পায় যৌথভাবে ঢাকার ‘সালেহ অ্যান্ড ব্রাদার্স’ ও ‘কামরুল অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে এ কাজও করেছেন আবদুল হান্নান। কার্যাদেশ অনুযায়ী চলতি বছরের ৬ মার্চ কাজ শেষ করার কথা। পুরোদমে এখনো কাজ শুরু হয়নি; অথচ ৫৩ শতাংশ অগ্রগতি দেখিয়ে গত ১২ জুন পর্যন্ত ১৯ কোটি ৩৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করেছেন ফজলে রব্বে।
এরই মধ্যে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন আবদুল হান্নান ও লুৎফুর রহমান। এ জন্য কাজও আর হচ্ছে না।
এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই সড়কের বিভিন্ন স্থানে এখনো খানাখন্দ। কোথাও কোথাও পাশের মাটি ধসে গেছে। সড়কের চাঁনপুর এলাকার কোপা নদীর ওপরের সেতুর দুই পাশে ধস দেখা দেওয়ায় বেইলি সেতু বসানো হয়েছে।
সড়কের ফতেপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, আবুয়া নদীর ওপর একটি নতুন সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুর উত্তর পাশের সংযোগ সড়কে কিছু মাটি ফেলা আছে। কিছু কিছু জায়গায় রাস্তার উভয় পাশে মাটির সোল্ডার ৫০০ মিটার বা কম এবং সিসি ব্লক পানিতে ধসে পড়ছে। কাজের শেষ মাথায় ৭ কিলোমিটারে কিছু স্লোপ ঢালাই হয়েছে; তা এখনই ভেঙে যাচ্ছে। নামমাত্র কাজ হলেও বারুঙ্কা নামক স্থানে এখনো নৌকা দিয়েই চলাচল করতে হয়।
কামরুল অ্যান্ড ব্রাদার্সের কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এমন কিছু লোকজন লাইসেন্সটা চায়, তখন না করা যায় না। তাঁরা নিয়ে কী কী কাজ করছেন, সব জানিও না। হান্নান ভাই একটি কাজ করছেন জানি। আমরা কোনোভাবে দায় এড়াতে পারি না। তবে আশা করি, তাঁরা না আসতে পারলেও তাঁদের প্রতিনিধির মাধ্যমে কাজ শেষ করিয়ে দেবেন।’
ওই প্রধান প্রকৌশলী কমিশন না পেলে অযৌক্তিক কারণে সময়ক্ষেপণ করে পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য রি-টেন্ডারিং করেন বলে অভিযোগ। এ নিয়ে ২০২৩ সালের এপ্রিলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিপিটিইউ মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন ঠিকাদার মো. কাউসার হামিদ।
সওজ সিলেট জোন অফিসের পাশেই কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর বাসভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ফজলে রব্বে সেখানে না থেকে থাকছেন রায়নগরে পরিত্যক্ত ভবন মেরামত করে। অভিযোগ আছে, অপকর্ম ও ভাগ-বাঁটোয়ারার সুবিধার জন্য তিনি জোন অফিসের পাশের নতুন ভবনে থাকেন না।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ফজলে রব্বে বলেন, ‘নিয়মের মধ্যে ইভাল্যুয়েশন করে কাজ দেওয়া হয়।নিয়মের বাইরে কিছুই করার সুযোগ নাই। আর অফিসের পাশে বানানো বিল্ডিং থাকার জন্য উপযুক্ত নয়। ভাগ-বাঁটোয়ারা, অপকর্মের কোনো ভিত্তি নাই। হান্নান ও লুৎফুর বা কোনো ব্যক্তির বিষয়ে আমি কথা বলব না। কোথাও অনিয়ম হলে তুলে ধরুন।’আজকের পত্রিকা