ডেস্ক রির্পোট:- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহতিপ্রাপ্ত দুর্নীতির অভিযোগের পুরনো ১০টি মামলা নতুন করে করতে পারবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শেখ হাসিনার এসব মামলা উচ্চ আদালত খারিজ করে দেন। তখন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেনি কমিশন। পরে সংস্থাটি থেকে প্রতিটি মামলায় আসামিদের সম্পৃক্ততাহীন দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে মামলার দায় থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মামলাগুলোর বিচারের দাবি উঠে আসছে।
জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (আইন অনুবিভাগ) ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, কোনো মামলায় একবার বিচার হয়ে গেলে একই অভিযোগে দ্বিতীয়বার বিচার হওয়ার সুযোগ নেই। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কোনো মামলায়ই বিচার হয়নি। ফলে এসব মামলা নতুন করে দায়ের করে বিচার কার্যক্রম অগ্রসরে আইনগত কোনো বাধা নেই।
তিনি আরো বলেন, ২০১০ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহারের সুপারিশ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেশ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগের মামলা সরকারিভাবে দুদকে পাঠানো হয়। তবে ওই সময় দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রত্যাহারের সুপারিশ নাকচ করে দেন। পরে আদালত এসব মামলা খারিজ করে দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ক্ষমতা ছিল।
কিন্তু রানিং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন ঝুঁকির কাজ কেউ করতে রাজি হননি। উচ্চ আদালত থেকে এমন রায়ের পর পরবর্তী কমিশন এসব মামলায় আসামিদের নির্দোষ দেখিয়ে বা মামলার অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থতা দেখিয়ে মামলায় চার্জশিটের পরিবর্তে এফআরটি (অব্যাহতি) দেয়।
১০ মামলা প্রত্যাহার : ২০১০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি দুর্নীতির অভিযোগের মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে সরকারিভাবে দুদকে পাঠানো হয়। তবে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সুপারিশ নাকচ করে দেন। পরে হাইকোর্টের রায়ে মামলাগুলো খারিজ হয়ে যায়।
মামলাগুলো বাতিলের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বলেছেন, অভিযোগ প্রমাণের জন্য কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি; তাই মামলাগুলো বাতিল করা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে মামলাগুলো করা হয়েছিল।
হাইকোর্টের দুই বেঞ্চ থেকে ৯ মামলা খারিজ : ২০১০ সালের ৩ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত তিন মাসে ৯টি দুর্নীতির অভিযোগের মামলা বাতিল করেন হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ। এর মধ্যে একটি বেঞ্চের বিচারপতি ছিলেন মো. শামসুল হুদা ও আবু বকর সিদ্দিকী এবং অপর বেঞ্চের বিচারপতি ছিলেন এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বোরহান উদ্দিন। বেঞ্চ দুটির দুই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ছিলেন শামসুল হুদা ও মানিক। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার পাঁচ মাস আগে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শামসুল হুদা এবং শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্টে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী দুই বছর পর রাষ্ট্রপতি তাঁদের চাকরি স্থায়ী করতে পারেন, আবার না-ও পারেন। তাঁদের অস্থায়ী নিয়োগ দুই বছর হলে ২০০৩ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার তাঁদের নিয়োগ স্থায়ী করেনি। এরপর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে ওই বছরের ২২ মার্চ তাঁরা হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে আবার স্থায়ী নিয়োগ পান।
বিচারপতি শামসুল হুদার বেঞ্চে তিন মাসে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা পাঁচটি মামলা বাতিল করে দেওয়া হয়। মামলাগুলো হলো ফ্রিগেট (যুদ্ধজাহাজ) ক্রয় দুর্নীতি মামলা, মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলা ও বেপজায় পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির মামলা। একই সময়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের হাইকোর্টের অপর বেঞ্চ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চারটি মামলা বাতিল করে দেন। মামলাগুলো হলো নভোথিয়েটার দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত তিনটি মামলা ও মিগ যুদ্ধবিমান ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগের মামলা।
নাইকো দুর্নীতি মামলা : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বিদেশি প্রতিষ্ঠান নাইকোকে তিনটি গ্যাস ফিল্ড থেকে অবৈধভাবে গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। মামলায় আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নাইকো রিসোর্সকে অবৈধভাবে এক হাজার ৭৯৪ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্রের ১৩ হাজার ৬৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়।
মিগ-২৯ বিমান ক্রয় : আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়ের দুর্নীতির অভিযোগে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময় ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর মামলাটি করা হয়। মামলায় শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নীতিমালা লঙ্ঘন করে রাশিয়া থেকে ১৬টি মিগ-২৯ বিমান কেনার চুক্তি হয়। এর মধ্যে আটটি সরবরাহ করা হয় এবং এর মূল্য হিসেবে ১২ কোটি ৯০ লাখ ইউএস ডলার (তৎকালীন মুদ্রামানে ৭০০ কোটি টাকা) পরিশোধ করা হয়। ১৬টির মধ্যে আটটি সরবরাহ না হওয়ায় সরকারের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়।
কোরিয়ান ফ্রিগেট ক্রয় : বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২০০২ সালের ৭ আগস্ট দুর্নীতি দমন ব্যুরো ফ্রিগেট কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করে। মামলায় দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নৌবাহিনীর জন্য পুরনো যুদ্ধজাহাজ ফ্রিগেট কেনায় সর্বনিম্ন দরদাতা চীনা কম্পানির পরিবর্তে চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা দক্ষিণ কোরীয় কম্পানিকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ৪৪৭ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়।
মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র : কেন্দ্রটি স্থাপনে দুর্নীতির অভিযোগে ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন ব্যুরো। ২০০২ সালের ১৪ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ মামলায় চার্জশিটও দেওয়া হয়। অভিযোগে বলা হয়, কেন্দ্রটি স্থাপনে অনিয়ম এবং দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের ১৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
খুলনায় ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র : বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের নামে তিন কোটি টাকা চাঁদা নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনে সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দরদাতাকে কাজ দেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলাটি করা হয়।
নভোথিয়েটার নির্মাণে দুর্নীতির তিন মামলা : ২০০২ সালের ২৭ মার্চ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আগের মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট একনেক সদস্যদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় তিনটি মামলা করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো। ব্যুরো বিলুপ্ত হয়ে দুদক গঠিত হলে মামলাগুলো সেখানে স্থানান্তরিত হয়। তিনটি মামলার একটিতে সাতজন, একটিতে আটজন ও আরেকটিতে ১২ জনকে আসামি করা হয়। বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নিয়ে একনেকের তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়ে মামলা তিনটি হয়।
সিদ্ধান্তগুলো হলো—প্রকল্পের পরামর্শকের ব্যয় বৃদ্ধি, ভবন নির্মাণের ব্যয় বৃদ্ধি ও কমকর্তা-কর্মচারীদের ব্যয় বৃদ্ধি। ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের দুদক এসব মামলায় চার্জশিট দিতে বলেছিলেন। তখন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা এই মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে দুটি রিট আবেদন করেন। ২০১০ সালের ৪ মার্চ চার্জশিট দাখিলের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, মামলা তিনটি অসৎ উদ্দেশ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে (শেখ হাসিনা) হেয়প্রতিপন্ন করতে করা হয়েছিল। মামলাগুলোয় মাওলানা ভাসানীর নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণ প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতি, অবৈধভাবে ব্যয় বাড়িয়ে রাষ্ট্রের ৫২ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
বেপজা পরামর্শক নিয়োগ দুর্নীতি : ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন ব্যুরো মামলাটি করে। মামলায় বেপজায় পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ফলে রাষ্ট্রের দুই কোটি ১০ লাখ এক হাজার ৬৮৮ টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।কালের কণ্ঠ