১৫ চিনিকলে উৎপাদন হয় চাহিদার ১ শতাংশ, ঋণ ৯ হাজার কোটি!

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৬২ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলে ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণের বোঝা। তবে চাহিদার ১ শতাংশেরও কম উৎপাদনে সক্ষম এই চিনিকল গুলো। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন এই চিনিকলগুলো পরিচালনা করছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চিনির চাহিদা ২২ থেকে ২৪ লাখ টন।
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে উৎপাদন মাত্র ২১ হাজার ৩০০ টন।

তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চিনির চাহিদা ২২ থেকে ২৪ লাখ টন। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে উৎপাদন মাত্র ২১ হাজার ৩০০ টন। এমন পরিস্থিতিতে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব চিনিকল স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরিয়ে আনতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

ঋণের বোঝা ৯ হাজার কোটি টাকাএই খাতে নতুন করে বরাদ্দ দিয়ে কলগুলোর আধুনিকায়ন এবং আখের উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছেন তাঁরা।

এসব চিনিকল নিয়ে প্রতিবছর নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কাগজে-কলমে ছক কষা এই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখে না। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, এই চিনিকল দেশের একটি শিল্পগোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা, শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্রতিবাদে সরকার ওই অবস্থান থেকে সরে আসে। এর আগেও যাঁরা শিল্পমন্ত্রী ছিলেন, তাঁরাও চিনিকলগুলোর প্রতি নজর দেননি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে পরবর্তী তিন বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার ২২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। এই ঋণের সুদ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে চিনিকল সংস্কারে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে তিন বছরে নেওয়া হয়েছে প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণ, যা পরিশোধে তাগিদও রয়েছে।

অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের ব্যয় কমাতে ২০১১ সাল থেকে জনবল নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে ১৭ হাজার ২৬৩ অনুমোদিত পদ থাকলেও জনবল ব্যয় কমাতে ৯ হাজার ১৭৩টি পদ শূন্য রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, লোকসান কমাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে পঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুর, রংপুর, কুষ্টিয়া ও পাবনা—এই ছয়টি চিনিকল বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু এতে কোনো লাভ হয়নি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ সাল থেকে তিন হাজার ৪০৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে গেছেন, যাঁদের গ্র্যাচুইটি পরিশোধ করা হয়নি। তাঁদের গ্র্যাচুইটি বাবদ বকেয়া রয়েছে ৩২৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ বকেয়া ১১৬ কোটি টাকা। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বাবদ পাওনা ৮১ কোটি টাকা। কোন উৎ থেকে এই বকেয়া শোধ করা হবে, তা ঠিক করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

পুরনো মিলে উৎপাদন কমছে

কাছের দেশ ভারত, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডে চিনিকলে রিকভারি ১০ থেকে ১১ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশে রিকভারি ৬ শতাংশের কম। প্রতিবছরই রিকভারির হার কমছে। এতে কমছে উৎপাদন। ২০১৬ অর্থবছরে যেখানে ৫৯ হাজার টন চিনি উৎপাদিত হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন গিয়ে ঠেকেছে ২১ হাজার ৩১৪ টনে।

দেশে চালু থাকা ১৫টি চিনিকলের মধ্যে তিনটি ব্রিটিশ আমলে, ৯টি তৎকালীন পাকিস্তান আমলে, মাত্র তিনটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এত পুরনো হওয়ায় এসব চিনিকলের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি, উৎপাদনও কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ২৬০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে হিসাব করেছে করপোরেশন।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৪১২ কোটি টাকা। বিপরীতে ব্যয় এক হাজার ১৯২ কোটি টাকা। এতে আয় ও ব্যয়ের বিশাল ব্যবধান সুস্পষ্ট।

চিনিকলগুলোর বর্তমান অবস্থা

প্রাইস গ্যাপ, ট্রেড গ্যাপ ও ভর্তুকি বাবদ সরকারের কাছে সাত হাজার কোটি টাকা দাবি করছে করপোরেশন। অন্যান্য দেশের মতো আখ ক্রয়ে ২৫ শতাংশ ভর্তুকি বাবদ ২৮০ কোটি টাকা দাবি করা হচ্ছে। সংস্থার সব ঋণ সুদসহ সরকারের কাছে পরিশোধের দাবি জানিয়েছে। বিদ্যমান চিনিকলের আধুনিকায়ন, বহুমুখীকরণ এবং নতুন চিনিকল স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।

করপোরেশনের কর্মকর্তাদের আশা, এভাবে চিনিকলের লোকসান কমিয়ে লাভজনক খাতে যাওয়া যাবে।

কিন্তু সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, যে গতিতে কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠান চলছে, এভাবে চললে আগামী তিন বছরের মধ্যে আরো দুটি চিনিকল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি।

বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশনের সাবেক সচিব মিজানুর রহমান বলেন, ‘সরকারি চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলে বেসরকারি আমদানিকারক কম্পানিগুলো ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করতে পারবে। এ কারণে তারা সুকৌশলে এই চিনিকল বন্ধ করে দিতে চায়। এস আলম গ্রুপের কাছে তিনটি চিনিকল বিক্রির নীতিগত সিদ্ধান্ত হলেও আমাদের বিরোধিতায় তা করতে পারেনি।’ তিনি বলেন, চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য হলেও সরকারি চিনিকলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

কোন ব্যাংকে কত ঋণ

চিনিকলের বকেয়া পরিশোধ ও সংস্কারে ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাঁচটি ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার ২২০ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদের পরিমাণ চার হাজার ১১৭ কোটি টাকাসহ মোট সুদ-আসল ৯ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক থেকে তিন হাজার ১০৫ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে।

এতে সুদ হয়েছে দুই হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। সুদ-আসলসহ মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকে সুদ-আসলসহ মোট ঋণ এক হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকে ৯১৭ কোটি, রূপালী ব্যাংকে এক হাজার ১১৯ কোটি এবং কৃষি ব্যাংকে প্রায় ১৪ কোটি টাকা।

চিনিকলে প্রতি কেজির উৎপাদন ব্যয়

ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ায় উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে। বর্তমানে সুদসহ প্রতি কেজি চিনিতে উৎপাদন ব্যয় সবচেয়ে বেশি রাজশাহী চিনিকলে ৫০৪ টাকা, সর্বনিম্ন নর্থবেঙ্গল চিনিকলে ২১৮ টাকা। অন্যান্য চিনিকলের মধ্যে জয়পুরহাট চিনিকলে উৎপাদন ব্যয় ৪৫১ টাকা, ফরিদপুর চিনিকলে ৪০৭ টাকা, মোবারকগঞ্জ চিনিকলে ৩৮৪ টাকা, নাটোর চিনিকলে ৩৫১ টাকা। গড়ে প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ ৩১২ টাকার বেশি। অথচ বাজারে এক কেজি চিনি বিক্রি হয় ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়।

রাজশাহী চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘প্রতি কেজি চিনির দাম বেশি পড়ছে। তবে বছরে তিন মাস যদি মিল চালু রাখা যায়, তাহলে উৎপাদন খরচ কমে যাবে। সে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। আমাদের আশা রয়েছে, চিনিকলগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াবে।’

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সচিব আনোয়ার কবির বলেন, করপোরেশন ১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত অনেক ঋণ নিয়েছে, যা সুদে-আসলে প্রায় তিন গুণ হয়েছে। এই সুদ মওকুফের জন্য আবেদন করা হয়েছে। বন্ধ চিনিকলগুলো চালুর বিষয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্র্যাচুইটি পরিশোধে ১০০ কোটি টাকা সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া গেছে। মিলগুলোর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু প্রকল্প তৈরি হচ্ছে।কালের কন্ঠ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions