চীন-ভারত উত্তেজনা ও সম্ভাব্য যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অবস্থান: একটি ভূ-রাজনৈতিক পর্যালোচনা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৭৮ দেখা হয়েছে

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ:- চীন-ভারত সীমান্তে সময় সময় টান-টান উত্তেজনা বিরাজ করে। পুরোপুরি যুদ্ধ (অল আউট ওয়ার) লাগার সম্ভাবনা মাঝেমধ্যে দেখা দেয়। চীন স্ট্যাডিলি বাট এগ্রেসিভলি আগাচ্ছে। চীনের প্রচ্ছন্ন আশকারা পেয়ে প্রায় বাংলাদেশের আয়তনের নেপালও ভারতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। মাত্র ১৫,০০০ বর্গমাইলের অনেকটা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভুটানও ভারতের বিরুদ্ধে সাহস দেখাতে পিছিয়ে নেই! উত্তেজনার সময় ভারতীয় মিডিয়ার খবরগুলো দেখলে বা পড়লে এক ধরনের আবেগী চিত্র দেখা যায়। কিন্তু চীনের বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক মিডিয়া দেখলে বা পড়লে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। ভারতের অতি আবেগী মিডিয়ার খবরগুলো দেখলে মনে হয় – এই যেন ভারত প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে, চীনকে কড়া জবাব দিতে জওয়ান ও বায়ুসেনা প্রস্তুত! আসলে কি তাই?

নিরপেক্ষভাবে ভূ-রাজনীতির পর্যবেক্ষণে দেখা যায় – ভবিষ্যৎ কোনো যুদ্ধে চীনের সাথে ভারত কোনোভাবেই পেরে উঠবে না। চীন বিশ্বের একটি অন্যতম বৃহৎ সুপার পাওয়ার-তারা যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তি ও অর্থনীতি উভয় দিক দিয়ে টক্কর দেয়ার চিন্তায়। সৈন্য, লোকবল ও অস্ত্রে চীনের শক্তি ভারতের প্রায় দ্বিগুণ বা তারও বেশি। প্রযুক্তি ও রিসোর্সে আধুনিক ও অনেক এগিয়ে – সপ্তাহের মধ্যে ১০০০ বেডের হাসপাতাল তৈরি করতে সক্ষম এটির প্রমাণ তারা কোভিড মহামারির সময় দেখিয়ে দিয়েছে। এখন চীন যেখানে নিজেই নিজের অস্ত্র তৈরি করতে পারে, ভারতকে সেখানে রাশিয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়। চীনের ‘একাডেমি অব মিলিটারি সায়েন্স’-এর সিনিয়র কর্নেল ঝাও শিয়াওজুর মতে, সমরাস্ত্রের দিক থেকে ভারত আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরেও চীনের সমকক্ষ হতে পারবে না।

তাছাড়া চীন অর্থনীতিতে বিশ্বে জায়ান্ট। ভারতের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে খুব দুর্বল। প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে। এখনও কোটি কোটি মানুষকে খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয়! এমতাবস্থায় একটি সুপার পাওয়ারের সাথে যুদ্ধে ভারত কতটুকু টিকে থাকতে পারবে এটা একটা বড় প্রশ্ন। এটা আবেগে ভাসমান ভারতীয় মিডিয়া না বুঝতে পারলেও মোদিজি (মোদি সাহেব) ভালো করেই বোঝেন। আর বোঝেন বলেই চীনের বিভিন্ন অপারেশনে দৃশ্যত ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার পরও চীনের বিরুদ্ধে শুধু তর্জন-গর্জন ও ফাঁকা বুলির মধ্যেই তার প্রতিশোধ নেয়ার বা জবাব দেয়ার তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখেন। এ ক্ষতি যদি পাকিস্তান করতো? অথবা ভারত যদি চীনের এই ক্ষতি করতো? কী প্রতিক্রিয়া যে হতো বা কী প্রতিশোধ যে নেয়া হতো তা সহজেই অনুমেয়! কেউ না বুঝলেও ভারতীয় জেনারেলরা ভালো করেই বোঝেন যে – চীনের বিরুদ্ধে তথাকথিত সার্জিক্যাল অপারেশনের (যা তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অতীতে চালিয়েছেন বলে বলে থাকেন) মতো কোনো অপারেশন চালালে চীন ভারতের বিরোধপূর্ণ হাজার হাজার বর্গমাইলের পুরো এলাকা দখল করে নেবে।

গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় খুব কমই ভারতের প্রকৃত বন্ধু রাষ্ট্র আছে। ভারত ঐতিহাসিকভাবে যদি তার সব প্রতিবেশীদের সাথে সুবিচার করতো, তাদেরকে সঠিক মর্যাদা দিতো এবং তাদের প্রাপ্য অধিকার-ন্যায্য হিস্যা দিয়ে আসতো তাহলে তার বিপদের সময় সেসব দেশগুলো তার পাশেই থাকতো। পাকিস্তান ভারতের চিরশত্রু (arch-rival), নেপাল বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে, ভুটানও মেরুদণ্ড খাড়া করার আলামত দেখাচ্ছে। যুদ্ধ বাঁধলে এদেশগুলো যে চীনের পক্ষেই যাবে তা সহজেই অনুমেয়। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের চলমান ভূ-রাজনীতির পরিপেক্ষিতে চীনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে পাকিস্তান যদি হাজার মাইল দূরে ভারতের অন্য ফ্রন্টে আক্রমণ করে বসে তাতে কেউ আশ্চর্য হবে না। যে যাই বলুক, দুই ফ্রন্টে দুই পারমাণবিক শক্তিধর (যারা যথাক্রমে বিশ্ব ও অঞ্চলিক পরাশক্তিও বটে) দেশের সাথে যুদ্ধ করার অবস্থায় নেই ভারত। ভৌগলিকভাবে ভারতের অবস্থান অনেকটা নাজুক।

বাকি থাকলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিপুল অংশ বিভিন্ন কারণে ভারতবিরোধী। এই ভারত বিরোধী হওয়ার পেছনে ভারতের দায় কম নয়। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একটি মারাত্মক ব্যত্যয় ছিল যে, তারা সবকটি আপেল এক বাস্কেটে রেখেছিল। মূলত: ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র চাপিয়ে বসেছিল দেড় যুগের উপর। ভারতের কারণেই পতিত সরকার তিন তিনটি ভুয়া নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। এজন্য সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিপুল অংশ ভারতবিরোধী। এমতাবস্থায় ৫ আগস্ট সফল গণ-অভ্যূত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ সরকার নিজের দেশের বিপুল জনসংখ্যা ও পরাশক্তিসম বৃহৎ উন্নয়ন পার্টনারের বিরুদ্ধে গিয়ে যুদ্ধে ভারতের পক্ষে দাঁড়ানো বাংলাদেশের যেকোনো সরকারের পক্ষে খুব কঠিন হবে।

সাধারণভাবে দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্য ভারতের বিদেশ নীতি বিশেষ করে প্রতিবেশীদের সাথে তার সম্পর্ক ও নীতি বহুলাংশে দায়ী। অঞ্চলিক পরাশক্তি হতে হলে মনকে বড় করতে হয়, হতে হয় উদার। নিজের জন্য যা ন্যায্যতা তা চাইতে পারেন তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু অন্যের ন্যায্যতা ও সমতা পাবার স্পৃহা এবং আকাঙ্ক্ষা বুঝতে হবে। এজন্যই তো আন্তর্জাতিক আইনে ও সম্পর্কে ‘ন্যায্যতা’ ও ‘সমতা’ এবং ‘আনুপাতিক হারে পাপ্যতা’ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কনসেপ্ট। অভিন্ন নদীর উজানের বাঁধ একতরফাভাবে বা ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আগাম উপযুক্ত তথ্য না দিয়ে ছেড়ে দেয়া শুধু আন্তর্জাতিক আইনেরই লঙ্ঘন নয়, বরং এটি প্রতিবেশীর প্রতি আগ্রাসী মনোভাব ও ছোট মনের পরিচয় বহন করে।

পৃথিবীর প্রায় ৬০টি দেশ সফর করার সুযোগ হয়েছে। পৃথিবীতে অনেক স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ আছে যাদের আয়তন বাংলাদেশের একেকটা জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়নের সমান। অনেক দেশগুলোর নিজস্ব বিমানবন্দর পর্যন্ত নেই। সে সব দেশগুলো অনেক কিছুতে তাদের পাশের বড় দেশের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। পৃথিবীতে তিনটি দেশ আছে যার চতুর্দিক অন্য বৃহৎ দেশ দ্বারা বেষ্টিত। যেমন ভ্যাটিকান ও সান মেরিনো পুরোপুরি ইতালি দ্বারা বেষ্টিত এবং লেসোথো দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বারা বেষ্টিত। অথচ এদেশগুলো স্বাধীন ও সার্বভৌম। কই তাদের মধ্যে বর্ডারে কোনো টেনশন বা উত্তেজনা দেখলাম না, হতাহত হওয়াতো কল্পনাতীত। ভারতের সত্যিই তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নিয়ে সোল-সার্চিং করা দরকার।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions