মুজিব মাশাল ও শায়েজা ওয়ালিদ:- যখন জেলাররা ভোরের আগেই কারাগারে ঢুকে পড়লো, বন্দিটি ভাবলো তার জীবন এখানেই শেষ। আট বছর ধরে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল একটি আন্ডারগ্রাউন্ড জেলের জানালাহীন প্রকোষ্ঠে। যেখানে অন্ধকার রাতের কোনো শেষ নেই। জেলের রক্ষীরা তাকে তার প্রার্থনা শেষ করার নির্দেশ দিল। তারপর তার চোখবন্ধ ও ধাতব হাতকড়া খুলে ফেলল এবং তার কবজি কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল । তারপর তারা সেই বন্দিকে দুজন লোকের নিচে একটি মিনিভ্যানের মেঝেতে শুইয়ে দিলো যাতে দেখা না যায়। এরপর এক ঘণ্টার যাত্রার উদ্দেশে রওনা দিলো। কিন্তু বাংলাদেশে আগের অনেক রাজনৈতিক বন্দির মতন, মীর আহমদ কাসেম আরমানকে হত্যা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল না। পরিবর্তে তাকে রাজধানী ঢাকার প্রান্তে একটি মাঠে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল।
অনেক পরিবর্তন হয়েছে: নতুন হাইওয়ে, পাতাল রেল । কিন্তু আরমান সর্বশেষ এবং সবথেকে বড় পরিবর্তন সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি গত ১৫ বছর ধরে লোহার মুষ্টি এবং প্রতিহিংসামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশ শাসন করেছিলেন বিক্ষোভকারীরা তার বাসায় হামলা চালালে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান । ৫ আগস্ট হাসিনার প্রস্থানের সাথে সাথে আরমান এবং আরও দুইজন ব্যক্তি যারা গোপন কারাগারে দীর্ঘকাল বন্দি ছিলেন তারা প্রকাশ্যে আসেন । আরমান ২০১৬ সালে আধাসামরিক বাহিনীর হাতে নিখোঁজ হওয়ার সময় একজন স্বচ্ছল আইনজীবী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অভিযোগ না থাকলেও একজন ইসলামপন্থী কর্মী এবং ব্যবসায়িক হিসেবে তার পিতার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার জন্য তাকে দায়বদ্ধ করা হয়। বছর খানেক পরে আরমানকে যখন খোলা মাঠে নামিয়ে দেয়া হলো তখন শরীর শীর্ণকায়, মুখে দাড়ি। অন্ধকার জীবনে কেবল দুটি জিনিস তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো, তার স্ত্রী এবং ১১ ও ১২ বছরের দুই কন্যা। বছর ৪০ এর আরমান বলেন, আমি প্রতিবার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতাম এই পৃথিবীতে আমার পরিবারের সাথে যদি একসঙ্গে থাকতে না পারি, অন্তত স্বর্গে গিয়ে তাদের সাথে যেন আমার দেখা হয়।’
হাসিনার পতন তার ১৭০ মিলিয়ন মানুষের দেশকে নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অতীতের সবচেয়ে খারাপ অপব্যবহারের উপর থেকে পর্দা তুলে দিয়েছে। একসময় তার জাতির গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার মূর্তপ্রতীক হাসিনা সময়ের সাথে সাথে কর্তৃত্ববাদ এবং দমন-পীড়নের পথ অবলম্বন করেন। সামনে আসা যে কোনো চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে হাতিয়ার করেন। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল জোরপূর্বক গুম। তার নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা অপহরণ করার পর শত শত মানুষ আজ কোনো চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে গেছে, কিছু ক্ষেত্রে ছোটখাটো রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের জন্যও তাদের টার্গেট করা হয়েছে: যেমন বিরোধী সমাবেশ সংগঠিত করা, প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ করা বা সোশ্যাল মিডিয়াতে কোনো সমালোচনামূলক বার্তা পোস্ট করা। নিহতদের অনেককে হত্যা করে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। বাকিদের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড মিলিটারি ডিটেনশন সেন্টারে দৃষ্টির বাইরে রাখা হয়েছিল, যাতে তারা নিজেরাই উন্মাদ হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। সেই কারাগারের কোড-নাম ছিল ‘হাউস অফ মিররস’ বা ‘আয়নাঘর’ । দ্য টাইমস আরমান এবং আগস্টে মুক্তি পাওয়া অন্য একজন বন্দিসহ দুই ডজনেরও বেশি লোকের সাক্ষাৎকার নিয়ে হাসিনার গোপন ডেরার গল্প প্রকাশ্যে এনেছে। সেইসঙ্গে বর্তমান এবংসাবেক সরকারি কর্মকর্তারা , নিরাপত্তা প্রধান, কূটনীতিক এবং মানবাধিকার কর্মীরাও মুখ খুলেছেন যাদের একসময় নীরব করে রাখা হয়েছিল।
এটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিবারগুলির একটি গল্প-আগস্টে মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন যখন জানতে পারেন যে তাকে মৃত বলে ধরে নিয়ে তার স্ত্রী পুনরায় বিয়ে করেছে। আরেকজন জানতে পারেন যে তার বাবা তার নিখোঁজ হওয়ার সূত্র খুঁজতে বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবশেষে মৃত্যুকে বরণ করে নেন। কয়েক ডজন যারা নিখোঁজ হয়ে গেছেন তাদের পরিবার এখনো তাদের অপেক্ষায় রয়েছেন যদি কোনো ঘরের লোকটি ফিরে আসে। এমনকি সরকারি দমন-পীড়ন এবং ভয় দেখানোর পরেও তারা আশা ছাড়েননি । তারা চান, হয় তাদের ছেলে, ভাই যারা নিখোঁজ তাদের ফিরিয়ে আনা হোক নতুবা মনের ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হোক। “কী হয়েছে আমরা সবটা জানতে চাই ?” বলছেন তাসনিম শিপ্রা। যার চাচা বেলাল হোসেন ২০১৩ সালে নিখোঁজ হয়ে যান।
একটি নির্মম ইতিহাস
বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ ছিল একটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ। যার অনেকটাই কাল্পনিক। দেশের পোশাক রপ্তানি শিল্প লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছিল। অবিচল, শক্তিশালী নেত্রী হিসেবে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন হাসিনা। কিন্তু ৫০ বছরের পুরনো জাতির মর্মান্তিক ইতিহাসের মূলে রয়েছে দুটি রক্তক্ষয়ী বিভাজন— ভারত থেকে পাকিস্তান, তারপর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এবং তখন থেকেই রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রতিহিংসার চক্রে জর্জরিত হয়েছে এই দেশ। হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পথ দেখাতে সাহায্য করেছিলেন। যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযান পরিচালনা করে লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করেছিল। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে একটি নির্মম আধাসামরিক বাহিনীকে খাড়া করে শেখ মুজিব দেশ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন । ১৯৭৫ সালে তিনি এবং তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। সে সময় বিদেশে থাকায় হাসিনা রেহাই পান । কয়েক বছর পরে তিনি ফিরে আসেন দেশে সামরিক শাসনের অবসান ঘটাতে এবং ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন।
পরের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়ে আট বছরের জন্য ক্ষমতা থেকে দূরে থাকেন । ২০০৪ সালে তিনি একটি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন যেখানে গ্রেনেড নিক্ষেপকারী হামলাকারীরা দুই ডজন লোককে হত্যা করেছিল। পরবর্তী রাজনৈতিক সংকটের সময় তাকে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে যখন তিনিক্ষমতায় ফিরে আসেন তখন তিনি একজন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত নেতা, বাবার মতো কঠোর হাতে দেশের নিয়ন্ত্রণ তুলে নেন নিজের হাতে। হাসিনা দমন-পীড়ন অভিযানে বেশ কিছু নিরাপত্তা বাহিনীকে নিয়োগ দেন। সেইসঙ্গে বিরোধীদের হত্যা ও নির্মূল করতে তিনি অভিজাত পুলিশ এবং আধাসামরিক ইউনিটকে ব্যবহার করেন। তাদের মধ্যে একটি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। যেটি মার্কিন এবং বৃটিশ প্রশিক্ষণ নিয়ে সন্ত্রাসবাদবিরোধী স্কোয়াড্রন হিসাবে কাজ শুরু করেছিল কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর মতে হাসিনা তাকে রূপান্তরিত করেছিলেন “ইন-হাউস ডেথ স্কোয়াড” হিসেবে। আদালতের নথি অনুসারে, হাসিনার দলের একজন কর্মকর্তা প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দিতে ব্যাটালিয়নের সদস্যদের অর্থ প্রদান করেছিলেন। আদালতের নথি মোতাবেক, যখন তারা দিনের আলোতে লোকটিকে তুলতে গিয়েছিল তখন সাক্ষী মেটাতে আরো সাতজনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তারা। মৃতদেহগুলিকে নদীতে ডুবিয়ে দিতে তাদের পেটে ছিদ্র করে দেয়া হয়েছিল এবং দেহের সাথে ইটের বস্তা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। এক সপ্তাহ পরে মৃতদেহগুলি নদীর ওপর ভাসতে দেখা যায় যা হাসিনা সরকারের বর্বরতার জ্বলন্ত উদাহরণ।
দীর্ঘমেয়াদী বন্দিদের আটকে রাখার ভার সামরিক গোয়েন্দা শাখার কাছে ন্যস্ত করা হয়েছিল। মানবাধিকার সংস্থাগুলির অনুমান অনুসারে, ২০০৯ থেকে এই বছর পর্যন্ত ৭০০ জনেরও বেশি লোককে জোর করে গুম করা হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত অনেক বেশি। কারণ ঘন ঘন সরকারি হয়রানি তাদের পক্ষে মামলার সম্পূর্ণ তথ্য নথিভুক্ত করার কাজ কঠিন করে তুলেছিল। পরিচিত নিখোঁজদের মধ্যে প্রায় ৪৫০ জন পরে ফিরে আসে। অধিকার গ্রুপগুলির দাবি তাদের নিখোঁজ করার কয়েক মাস পরে ছেড়ে দেয়া হয় এবং মুখ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। ৮০ টি পরিবার শুধুমাত্র তাদের আপনজনের মৃতদেহ হাতে পেয়েছিলো , প্রায় ১৫০ ভুক্তভোগীরই হিসাব পাওয়া যায়নি।
সামরিক বাহিনী হাসিনার বর্বরোচিত কাজে সয়াহতা করে এসেছে । কারণ তিনি শক্ত হাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন। তিনি তার এক আত্মীয় অবসরপ্রাপ্ত সেনা জেনারেলকে সামরিক বিষয়গুলি সমন্বয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি সেনার বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করতে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের দরাজ হাতে অর্থ বেলানোর পরামর্শ দিতেন। বন্দিদের আটকে রাখার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ অবদানকারী হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। হাসিনার প্রস্থানের সাথে সাথে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলি ভেঙে যাওয়ার পরে সামরিক বাহিনীই নিজেকে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে খাড়া করেছিল, কঠিন সময়ে বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার আশ্বাস দিয়েছিলো।
আয়নাঘরের ভেতরের গল্প
আবদুল্লাহিল আমান আজমি যে অবিরাম যন্ত্রণা সহ্য করেছেন তা হয়তো ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। আজমি একজন সাবেক সেনা জেনারেল যাকে স্পষ্টতই দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কারণ তার বাবা একজন সিনিয়র ইসলামিক নেতা ছিলেন। আগস্টে সামরিক কারাগার থেকে মুক্তি পান আজমি। আট বছরের বন্দি জীবনে তাকে ৪১,০০০ বার চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরানো হয়েছিল। আজমি বলছেন, আমি সৃষ্টিকর্তার তৈরি আকাশ, সূর্য, চাঁদ, গাছ দীর্ঘদিন দেখিনি। একবার একটা ছোট ঘুলঘুলি দিয়ে কিছুটা সূর্যালোক দেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারা সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে জানতে পেরে সেগুলি বন্ধ করে দেয়।”
আয়নাঘরের অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রটি ছিল কঠোরভাবে পরিচালিত । সেখানে বন্দিদের মেডিকেল চেকআপের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যবস্থা ছিল। চার থেকে ছয় মাস অন্তর বন্দিদের চুল কাটা হতো । আয়নাঘরের লক্ষ্য ছিল বন্দিদের শারীরিক অত্যাচার, মানসিক অত্যাচার করা। টাইমসকে প্রাক্তন বন্দীদের মধ্যে তিনজন জানিয়েছেন আয়নাঘরে ছিল লম্বা করিডোর, সেখানে অর্ধডজন কক্ষ থাকলেও একটি অপরের থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল। প্রতিটি প্রান্তে শৌচাগার ছিল, একটি দাঁড়ানো এবং একটি বসা। প্রতিটি কক্ষে একটি বড় এক্সজস্ট ফ্যান ছিল যাতে আওয়াজ বাইরে না যায়। কাতার এবং ভিয়েতনামে সাবেক বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান ২০১৯ সালে পুনরায় আবির্ভূত হওয়ার আগে কারাগারে ৪৬৭ দিন কাটিয়েছেন। তিনি গুগল ম্যাপ খোলেন এবং ঢাকার একটি সামরিক গ্যারিসনে জুম ইন করেন, যে অংশটিকে এখন আয়নাঘর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই কোড নামটি প্রথম প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশি সংবাদ সংস্থা নেত্র নিউজ, যা প্রবাস থেকে পরিচালিত হয় ।
তিনি এবং অন্যান্য বন্দিরা জানতেন যে, তারা সামরিক ঘাঁটিতে ছিলেন যেখান থেকে সকালে সেনাদের প্যারেড শুনতে পাওয়া যেত । তারা জানত যে, অফিসারদের আবাসিক কোয়ার্টার এই আয়নাঘরের কাছাকাছিই ছিল, যেখানে মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। জামান বলছেন “প্রতি শুক্রবার, আমি শিশুদের গান শুনতে পেতাম। ‘ হাসিনার কট্টর সমালোচক জামান বলছেন, ‘আমাকে ভারতে থাকার বিষয়টি নিয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিলো এবং মুখে বারবার ঘুষি মেরে দুটি দাঁত ভেঙে দেয়া হয়েছিল । আমার সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট এবং ব্লগ মুদ্রণ করে এনে নির্দিষ্ট অনুচ্ছেদ ধরে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ‘
মাইকেল চাকমা, একজন আদিবাসী অধিকারকর্মীকে আগস্টে একটি জঙ্গলে মুক্ত করা হয়েছিল। চাকমা বলছেন, পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম আমি দিনের আলো দেখলাম।’ ২০১৯ সালে ঢাকার একটি ব্যাংকে প্রবেশের সময় তাকে অপহরণ করা হয়। তিনি বাংলাদেশের আদিবাসী পাহাড়ি জনগণের স্ব-শাসনের জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কারাগারের অভ্যন্তরে থেকে তিনি একটি প্রশ্ন শুধু করেছিলেন কেন তাকে সেখানে আনা হলো। উত্তর পেয়েছিলেন- রাজনৈতিক প্রতিহিংসা:হাসিনা যখন তার দলের জন্য একটি সমাবেশ করতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকায় গিয়েছিলেন, তখন চাকমার দলের ছাত্র সংগঠন আওয়ামী লীগের রাস্তা অবরোধ করে। হাসিনা সমাবেশে তার বক্তব্য শেষ করেন হুমকি দিয়ে—যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের তিনি দেখে নেবেন।
সাবেক সামরিক অফিসার আজমি বলছেন যে, কখনও কখনও তার চোখ -নাক এতটাই শক্ত করে বাঁধা হতো যে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো । তিনি চোখের ব্যথা, দাঁতের ক্ষয় এবং ত্বকের ক্ষতে ভুগছিলেন। তার থেকেও মনে সবসময় ভয় কাজ করতো। এই বুঝি কোনো রাতে তাকে বের করে নিয়ে যাওয়া হতে পারে , হত্যা করে দেহ কোথাও ফেলে দিতে পারেন রক্ষীরা। পরের দিন সকালের সংবাদপত্রে শুধু একটি খবর পাওয়া যাবে তিনি পুলিশের সাথে “ক্রসফায়ারে” মারা গেছেন। আজমি রক্ষীদের কাছে শুধু একটি প্রার্থনা করেছিলেন: “দয়া করে বিড়াল এবং কুকুরকে আমার মৃতদেহ খেতে দেবেন না, দয়া করে আমার লাশ আমার পরিবার, প্রিয়জনদের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। এমন কোনও ভাষা নেই যেখানে আমি আমার অপমান ও যন্ত্রণা বর্ণনা করতে পারবো।’
আরমানকে ২০১৬ সালের আগস্টে তুলে নেয়া হয়েছিল। সেখানে ছিল তার স্ত্রী এবং ৪ বছরের মেয়ে। হাসিনা সরকার ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলানোর আগে আরমানকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। মীর কাসেম আলী বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতাকারী একটি ইসলামিক দলের কিশোর ছাত্র নেতা ছিলেন। আলীকে হাসিনার জন্য বিশেষভাবে হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছিল কারণ তিনি একটি বৃহৎ এবং লাভজনক ব্যবসা গড়েছিলেন : একটি ব্যাংক, একটি মিডিয়া নেটওয়ার্ক, হাসপাতাল। আরমান তার বাবার কথা বলতে গিয়ে জানাচ্ছেন – ‘আমার বাবার একটি দিনও জেলে কাটানোর কথা নয়, ফাঁসি তো দূরের কথা। ‘বছরের পর বছর যন্ত্রণা এবং অনিশ্চয়তার পর আরমান হাসপাতাল থেকে ফিরে অবশেষে তার স্ত্রী, কন্যা এবং মায়ের সাথে পুনরায় মিলিত হতে সক্ষম হন । কিন্তু তিনি এখনো সেই মুহূর্তগুলি ভুলতে পারেননি: বাবার মৃত্যুদণ্ড, পারিবারিক জীবন থেকে চুরি হয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি বছর, দুর্ব্যবহার- যা হয়তো ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না।
ন্যায়ের জন্য একটি অনুসন্ধান
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুরুষ ও নারীদের একটি ছোট দল উল্লাসিত জনতার মধ্যে মিশে গিয়ে দেশের সামরিক সদর দফতরের গেটে পৌঁছে গিয়েছিলো। এদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি ছিলেন যারা বলপূর্বক গুম থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন । নারীরা তাদের নিখোঁজ প্রিয়জনের জন্য বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন দরজায় কড়া নেড়ে গেছে। তাদের একটিই দাবি ছিল -আয়নাঘরের ভিতরে এখনও কোনো বন্দি থাকতে পারে। যদি তারা এখনো কমান্ডিং অফিসারদের চোখে না পড়েন তাহলে তারা চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন। মধ্যরাতের কাছাকাছি অফিসাররা শেষ পর্যন্ত তিনজন প্রতিনিধিকে বৈঠকের জন্য অনুমতি দেয়। বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তিরা অফিসারদের জানান যে, তারা অন্তত দুজন লোককে এখনো ভেতরে আটকে রেখেছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল যিনি ১৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে জোরপূর্বক নিখোঁজ ছিলেন তিনি বলেন, ‘আমাদের ২৪ ঘণ্টা সময় দিন, আমরা দেখছি। যদি কেউ বাকি থাকে আমরা নিশ্চিত করব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের যেন মুক্তি দেয়া হয়। ‘ পরের কয়েক দিনের মধ্যে – চাকমা ,আরমান, আজমি সকলেই মুক্ত হয়ে যান।
সানজিদা ইসলাম তুলি যার ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমন ২০১৩ সালে নিখোঁজ হয়েছিলেন, তিনি বিচারের দাবিতে সরব হয়েছেন। সুমনের বৃদ্ধ মা তার নিখোঁজ ছেলের একটি ফ্রেমযুক্ত প্রতিকৃতি জড়িয়ে ড. ইউনূসের পাশে চুপচাপ বসেছিলেন। যা দেখে ইউনূস বলেন, ‘যদি দেশের অন্তর্বর্তীকালীন নেতারা তাদের জন্য ন্যায়বিচার করতে না পারেন তাহলে এই সরকারের কোনো অর্থ নেই।”
এর পরের সপ্তাহগুলিতে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলপূর্বক গুমের বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং বাংলাদেশে অপরাধ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। যার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্তের জন্য গঠিত একটি বিশেষ আদালত বিদেশে নির্বাসিত হাসিনার জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। কিন্তু সামনে অনেক কঠিন কাজ রয়েছে। ইউনূস যে ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা পূরণ করা এখন লক্ষ্য অন্তর্বর্তী সরকারের। ইউনূস বলেন, “আপনারা আশা ছাড়বেন না , তবে ফলাফল কী হবে তা এখনই বলতে পারা কঠিন। ‘
মুজিব মাশাল দ্য টাইমসের দক্ষিণ এশিয়ার ব্যুরো প্রধান। তিনি বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং ভুটান সহ ভারত এবং এর আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের কভারেজের নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেন।
সূত্র- নিউ ইয়র্ক টাইমস