ডেস্ক রির্পোট:- ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলম ওরফে এস আলমের দুই ছেলে আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম মাহির অপ্রদর্শিত ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করা হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে এ কাজটি করায় সরকার ৭৫ কোটি টাকা কর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। প্রথমে দুটি পে-অর্ডার দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে কালোটাকা সাদা করতে ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় দফায় কয়েক মাস পর আইনগত সময় পার হওয়ার পর তাঁদের এ সুবিধা দেওয়া হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখার মাধ্যমে এ কাজটি করা সম্ভব হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে ১৪ অক্টোবর জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে এস আলমের ছেলেদের এ আর্থিক অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তে এসব ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন কর কমিশনার (বর্তমানে সদস্য–আন্তর্জাতিক) সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ, সহকারী কর কমিশনার মো. আমিনুল ইসলাম, যুগ্ম কর কমিশনার এ কে এম শামসুজ্জামান, যুগ্ম কমিশনার সাইফুল আলমসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।
এনবিআরের তদন্ত কর্মকর্তা (কর কমিশনার) মোহাম্মদ আবদুর রকিব তদন্তকাজের অংশ হিসেবে বিভিন্ন স্তরের ১১ জন কর্মকর্তার জবানবন্দি নেন। জবানবন্দিতে জানা গেছে, সদস্য আবু দাউদ এ কাজে অধীন কর্মকর্তাকে এমনকি কুমির ও বাঘের ভয়ও দেখান। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল বৃহস্পতিবারই আমিনুল ইসলাম, এ কে এম শামসুজ্জামান, সাইফুল আলমসহ তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।
প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এস আলমের দুই পুত্রের নামে অপ্রদর্শিত ৫০০ কোটি টাকা কর বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এবং নিজেদের মালিকানাধীন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বাধ্য করে জালিয়াতির মাধ্যমে বৈধ করা হয়। ব্যাংক কর্মকর্তাদের বাধ্য করে ২০২১ সালের ১৯ ও ২০ ডিসেম্বর তারিখে দুটি ভুয়া পে-অর্ডার ইস্যু করানো হয়। এ ইস্যু করা পে-অর্ডার দেখিয়ে আয়কর কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে আয়কর নথির সব কাগজপত্র তৈরি করা হয়। কিন্তু কর অফিস ও ব্যাংকের রেকর্ডপত্র, বিভিন্ন রেজিস্টার ও চিঠিপত্র পর্যালোচনা করে পে-অর্ডার গ্রহণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সংস্থাটির কর কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রকিবের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘করদাতা আসাদুল আলম মাহির ও আশরাফুল আলম তাঁদের দাবি করা মনোনীত প্রতিনিধি নিউটন চক্রবর্তী তৎকালীন সার্কেল কর্মকর্তা অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মো. আমিনুল ইসলামসহ কর অঞ্চলের একটি চক্রের সহযোগিতায় বেআইনি প্রক্রিয়ায় ২৫০ কোটি টাকা করে মোট ৫০০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন। এর মাধ্যমে ৭৫ কোটি টাকা কম কর দিয়ে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অসৎ উদ্দেশ্যে আয়কর নথির সব রেকর্ডপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। এমনকি অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের পরিবারের মালিকানাধীন ব্যাংকের আইটি ব্যবস্থায় কারসাজি (ম্যানিপুলেট) করে তিনটি ব্যাংক হিসাবে ভুয়া তথ্য সন্নিবেশিত করেছেন। ঘটনাটির সঙ্গে অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মো. আমিনুল ইসলাম সরাসরি জড়িত। তৎকালীন পরিদর্শী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. সাইফুল আলমও (বর্তমানে অতিরিক্ত কর কমিশনার) এই পরিকল্পিত অপকর্মের দায় এড়াতে পারেন না। তদন্ত কর্মকর্তার অভিমত, স্পষ্টতই এর সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রেঞ্জ-৪-এর যুগ্ম কর কমিশনার এ কে এম শামসুজ্জামান পরবর্তী সময়ে প্রকৃত ঘটনা জেনে রাজস্ব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করলেও পরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা স্থগিত করেন। তদন্তকালে তিনি তৎকালীন কর কমিশনারের চাপে কার্যক্রম স্থগিত করার কথা মৌখিকভাবে স্বীকার করেন। দৃশ্যত এ ধরনের আইনবহির্ভূত কার্যক্রম থেকে তিনি অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। অনিয়মের মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করার ঘটনাপ্রবাহে (কর অঞ্চল-০১, চট্টগ্রাম) তিনজন কর কমিশনার দায়িত্ব পালন করলেও অপকর্মটি সংঘটিত হওয়ার প্রকৃত সময়ে কর্মরত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (গ্রেড-১), সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ। প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণ, এত বড় একটি অপকর্ম তাঁর অজ্ঞাতসারে ঘটেনি বলেই প্রতীয়মান। তবে এ বিষয়ে অন্য দুজন কর কমিশনার মো. রিয়াজুল ইসলাম ও মো. ইকবাল বাহারের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে জালিয়াতির মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করে রাষ্ট্রের রাজস্ব ক্ষতি করায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের মাধ্যমে তদন্ত করে হৃত রাজস্ব পুনরুদ্ধার করা যায়। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের তথ্যে কারসাজির বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। প্রতিবেদনে কর পরিদর্শক লোকমান আহম্মেদ, প্রধান সহকারী জমির আহমেদ, তৎকালীন যুগ্ম কর কমিশনার সাইফুল আলমও ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে তৎকালীন কর কমিশনার (বর্তমানে সদস্য–আন্তর্জাতিক) সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ বলেন, ‘এস আমলের দুই ছেলের রিটার্ন দাখিল করা হয় ২০২১ সালের ২৯ জুন। তখন আমি কর অঞ্চল-১ চট্টগ্রামের কমিশনার ছিলাম না। তখন কমিশনার ছিলেন রিয়াজুল ইসলাম। তখনই রিটার্নগুলো গ্রহণ করা হয়। আমি ২০২১ সালের ১ নভেম্বর যোগদান করি। পরে আমার কার্যকালীন একজন এগুলোর অ্যাসেসমেন্ট (যাচাই) করে। কিন্তু আমাকে কিছুই জানানো বা অনুমোদন নেওয়া হয়নি।’আজকের পত্রিকা