ডেস্ক রির্পোঠ:- অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার ৬০ দিন পূর্ণ হলো আজ। একই সঙ্গে পূর্ণ হলো বর্তমান সরকারের দুই মাস। আলোচ্য সময়ে সরকারের বেশ কিছু অর্জন রয়েছে উল্লেখ করার মতো; আবার কিছু বিষয় অগ্রাধিকারে থাকলেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুনর্গঠনের যে মহাদায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন আদায় করা। সেই কাজটি খুব ভালোভাবেই সামাল দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘে তাঁর উপস্থিতি ছিল তাক লাগানো। তিনি বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠক করেছেন। বৈঠক করেছেন ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট ছাড়াও কানাডা, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, নেপালের সরকার প্রধানের সঙ্গে। শুধু তাই নয়, লক্ষ্য অনুযায়ী সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পেতে তিনি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো দাতা সংস্থাগুলোর প্রধানের সঙ্গেও বৈঠক করেন। রোহিঙ্গা ইস্যুসহ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পাশে থাকতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করেন। গণহত্যার বিচারের বিষয়ে আলোচনা করেন আইসিসির প্রধান কৌঁসুলির সঙ্গে। জাতিসংঘে ড. ইউনূসের এ সফর কূটনৈতিক অঙ্গনে এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে পার্শ্ববর্তী ভারতের গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা এ নিয়ে পৃথক প্রতিবেদন করেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, নিউইয়র্কে ড. ইউনূসকে মনে করা হচ্ছিল একজন জনপ্রিয় রকস্টারের মতো। জাতিসংঘে বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকে তিনি যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন, তা ছিল দুর্দান্ত। বাংলাদেশ বিষয়ে তাঁদের আস্থা ফিরে এসেছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ড. ইউনূস এবং তাঁর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চান। তাঁরাও বোঝেন যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অত্যন্ত গভীর সংস্কার প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সূত্রগুলো জানাচ্ছে, প্রথম মাসে শুরু করা কিছু সংস্কার উদ্যোগ দ্বিতীয় মাসে সম্পন্ন করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হচ্ছে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশনের মধ্যে পাঁচটি কমিশনের সদস্য মনোনীত করে পূর্ণাঙ্গ করা। সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম শুরুর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের দাবি ছিল। এরই মধ্যে সেটিও সম্পন্ন হয়েছে। এখন পুরোদমে কাজ শুরু করেছে কমিশনগুলো। জুলাই গণহত্যার বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়। প্রধান উপদেষ্টাকে সভাপতি এবং শহীদ মীর মুগ্ধের ভাই মীর স্নিগ্ধকে সাধারণ সম্পাদক করে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কার্যকরী পরিষদ গঠন করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের প্রথম সভার পর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে এ ফাউন্ডেশন থেকে প্রতিটি শহীদ পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ও আহত প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়ার। প্রাথমিকভাবে শহীদ ও আহতদের একটি তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে।
কূটনৈতিকভাবে ড. ইউনূসের আরেকটি সাফল্য হচ্ছে ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মধ্যে তিনি তাঁর পুরনো বন্ধু, আসিয়ানের প্রভাবশালী রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে ঢাকা সফরে সম্মত করিয়েছেন। ঢাকায় এসে আনোয়ার ইব্রাহিম ভিসা করেও যেসব বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, তাদের নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, আসিয়ানে সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনারশিপ হতে বাংলাদেশের প্রস্তাবে সমর্থন জানানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়ে গেছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল- সেটিও কমতে শুরু করেছে। গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসছে। বেশির ভাগ ব্যাংকে তারল্য পরিস্থিতি ভালো। রেমিট্যান্স প্রবাহও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। প্রবাসীরা এখন হুন্ডির বদলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন। এ ছাড়া সরকারের উদ্যোগের ফলে তৈরি পোশাক খাতে শ্রম অসন্তোষ থেমেছে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, এতসব অর্জনের পরও কিছু ইস্যুতে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা বেড়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক উৎপাদন খাতে। বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে রপ্তানি আয়ের ভুল পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। এই প্রেক্ষাপটে গত আগস্ট থেকে রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করছে না ইপিবি। ফলে দেশের প্রকৃত রপ্তানি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। অস্থিরতা বেড়েছে শেয়ারবাজারে। হাজার কোটি টাকার মূলধন হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। মোকাবিলা করা যায়নি দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় স্বল্প আয় ও সীমিত আয়ের মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। অবশ্য গতকাল সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার মনিটরিংয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল যেটি- সেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি চোখে পড়ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন খোদ প্রধান উপদেষ্টা। একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, ‘এখনো তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। নানা রকম ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যার মধ্যে যেতে চাই না। কিন্তু এখনো উন্নতি হয়নি। কিঞ্চিত হয়েছে হয়তো। কিন্তু যে পর্যায়ে আসার কথা, সেই লেভেলে হয়নি। কাজেই আমাদের সার্বিক চেষ্টা হবে, ওটাকে আগে স্থির করা। এটা প্রথম কাজ।’ বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যেও পুরনো চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এখনো ব্যাংকগুলোতে এলসি সমস্যা হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছি না। ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যেও এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। তিনি বলেন, কিছু ব্যবসায়ীর নামে হত্যা মামলা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধিতা থাকে। এ কারণেও অনেকে এখন প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীদের হয়রানির সুযোগ নিচ্ছেন। এসব ঘটনা অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে বলে শঙ্কা এ ব্যবসায়ী নেতার।বাংলাদেশ প্রতিদিন