ভারতে প্রশাসনের সামনেই আওয়ামী লীগ নেতাদের অবৈধ বাস

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৭৮ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- ভারতে পালিয়ে গিয়ে তিন ধরনের সংকটে পড়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। বেশ কয়েকজন নেতা বলেছেন, নিজেদের সঙ্গে করে আনা টাকা প্রায় ফুরিয়ে গেছে। দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিতে হচ্ছে তাদের। পাশাপাশি অনেকের কাছে পাসপোর্ট নেই। এ ছাড়া কারও কারও ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এই তিন সংকট তাদের জন্য বড় ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপি অবৈধভাবে দেশ ছেড়েছেন। আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশত্যাগের এই প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে।

নেতারা অবৈধ পথে দেশ ছাড়ায় ইমিগ্রেশন বিভাগের নথিতে কারোরই দেশত্যাগের তথ্য পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ ছাড়াও সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং তাদের পাশাপাশি মধ্যম ও তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা দেশ ছেড়েছেন। বেশির ভাগই ভারতে গেছেন। অন্য কয়েকটি দেশেও গেছেন কয়েকজন।
ভারতে আত্মগোপনে থাকা কয়েকজন নেতা জানান, এখন তারা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে অর্থ পাঠানোর অনুরোধ করছেন। তারা হুন্ডি করে টাকা পাঠাচ্ছেন ভারতে। তা ছাড়া পরিচিতদের মধ্যে যারা চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছেন, তাদের মাধ্যমেও টাকা পাঠানো হচ্ছে।

‘কেন দেশ ছাড়লেন’– এমন প্রশ্নের জবাবে পলাতক কয়েকজন নেতা বলেন, ‘শেখ হাসিনাই দেশ ছেড়েছেন, আমরা তো ছাই। দেশে থাকলে প্রাণ থাকবে না। পিটিয়ে মারবে।’ আত্মগোপনে থাকা এই নেতারা জানান, তাদের পাসপোর্ট বা ভিসা না থাকলেও এখনও চলাচল করতে সমস্যা হচ্ছে না। তাদের ভাষায়, ভারতের প্রশাসন এসব দেখেও দেখছে না।
নেতারা জানান, তারা ভারতের নাগরিকদের মতোই অবাধে চলাফেরার সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের কয়েকজন দলগতভাবে আবাসিক হোটেলে থাকছেন। কেউ থাকছেন একা, ফ্ল্যাটে। সময় কাটছে ফেসবুক, ইউটিউব দেখে। পলাতক নেতারা একে অন্যের সঙ্গে টেলিফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। তবে স্ত্রী ও সন্তানের জন্য তাদের দুশ্চিন্তা। একজন বলেন, ‘সাগরে পড়ে গেছি। কূল নাই, কিনারা নাই। কোথায় যাই?’

৫ লাখ থেকে ২ কোটি টাকায় রফা
অবৈধ পথে ভারতে যাওয়ার বেলায় সিলেটের কানাইঘাট, সনাতনপুঞ্জি ও ডোনা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, নেত্রকোনা, দিনাজপুরের হিলি, যশোরের বেনাপোল ও পুটখালী ঘাট, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ও লালমনিরহাটের দহগ্রাম সীমান্ত ব্যবহৃত হচ্ছে। সীমান্ত পার হওয়ার পর ভারতের কলকাতা, আগরতলা, ত্রিপুরা, দিল্লি, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে অবস্থান নিয়েছেন।
সীমান্ত পার হতে জনপ্রতি ৫ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে দুই দেশের দালালদের।

কেউ কেউ কমে রফা করতে পেরেছেন। অনেকের কাছে থাকা বড় অঙ্কের টাকা কেড়ে নিচ্ছে দালাল চক্র। সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ভারতে পালাতে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়েন। এ সময় ধারণ করা ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, তাঁর কাছে থাকা ৬০-৭০ লাখ টাকা নিয়ে গেছে দালালরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় গত ১২ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। তিনি প্রায় ২ কোটি টাকার বিনিময়ে ভারতে যাওয়ার রফা করেছিলেন বলে জানা গেছে।

শেখ পরিবারের সদস্যরা কোথায়
শেখ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিমের কোনো খোঁজ নেই। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর অবস্থানও কেউ বলতে পারছে না। তিনি সম্পর্কে শেখ হাসিনার খালু।
তবে ভারতে পালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দীন, তাঁর ছেলে সাবেক এমপি শেখ সারহান নাসের তন্ময়, শেখ হেলাল উদ্দীনের ভাই সাবেক এমপি শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল, শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই সাবেক এমপি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং তাঁর ছেলে বরিশালের সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ।

সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও মেয়র ভারতে
ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে দেখা গেছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান, সাবেক কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং কুমিল্লার সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার সূচনাকে।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও অনেকে ভারতে অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন– দলের সভাপতিমণ্ডলীর দুই সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম ও অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, চার সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, এসএম কামাল হোসেন, মির্জা আজম ও শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, আইন সম্পাদক কাজী নজিবুল্লাহ হীরু, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুস সবুর, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম, কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন, উপাধ্যক্ষ রেমন্ড আরেং, নির্মল কুমার চ্যাটার্জি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহাম্মদ মন্নাফি, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান এবং যুব মহিলা লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল।
সাবেক এমপি একেএম শামীম ওসমান সপরিবারে ভারতে পালিয়েছেন। সাবেক এমপিদের মধ্যে তাঁর পথ ধরে ভারতে পালিয়েছেন মহিউদ্দীন মহারাজ, মাহমুদুল হক সায়েম, শরীফ আহমেদ, মোহিত উর রহমান শান্ত, ফাহ্‌মী গোলন্দাজ বাবেল, মোশতাক আহমেদ রুহী, সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ, সোলায়মান সেলিম, নাহিম রাজ্জাক, আবু জাহির, আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী নাসিম, নিজাম উদ্দিন হাজারী, শাহীন চাকলাদার ও শেখ আফিল উদ্দিন।

অন্য দেশে গেছেন যারা
সরকার পতনের পরপরই ভারতে যান সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। সেখান থেকে তিনি বেলজিয়ামে গেছেন। দেশটির নাগরিকত্ব রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া ভারত হয়ে লন্ডন গেছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবং সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। কানাডায় আছেন সাবেক অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান।
তারা ছাড়াও ভারত থেকে লন্ডন গেছেন সিলেটের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, সাবেক চার এমপি রনজিত চন্দ্র সরকার, হাবিবুর রহমান হাবিব, সাজ্জাদুল হাসান ও সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের দুই সদস্য সানজিদা খানম ও গোলাম কবীর রাব্বানী চিনু গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

অন্য নেতারাও ভারতে
যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ সরকার পতনের দু’দিন আগে কানাডা থেকে দেশে ফেরেন। গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি ভারতে পালান। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলও ভারতে। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু ভারতে আছেন।
ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের ঠিকানা এখন ভারত। এই দুই নেতার মতো ভারতে রয়েছেন সংগঠনটির সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ।

গণঅভ্যুত্থানের আগেই দেশত্যাগ
আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কয়েক দিন আগে দেশ ছাড়েন। সাবেক যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন ছিলেন লন্ডনে। সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীও ছিলেন দেশের বাইরে। এ ছাড়া স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য গণঅভ্যুত্থানের মাসখানেক আগে ভারতে যান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক সাবেক এমপি মৃণাল কান্তি দাস।
গণঅভ্যুত্থানের কয়েক দিন আগে দেশ ছাড়েন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। তিনি এখন ভারতে। তাঁর মতো ৩ আগস্ট সিঙ্গাপুর যান শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। সেখান থেকে তিনি লন্ডন গেছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি গণঅভ্যুত্থানের আগের দিন ছিলেন থাইল্যান্ডে। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্র অথবা লন্ডনে অবস্থান করছেন। অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য আগে থেকেই ভারতে ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন।

খোঁজ নেই ওবায়দুল কাদেরের
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কোনো খোঁজ নেই। কেউ কেউ বলছেন, সরকার পতনের পর ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান ছিল যশোরে। সেখান থেকে তিনি অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভারত গেছেন। কেউ বলছেন, দুবাই কিংবা সিঙ্গাপুরে আছেন। আবার কারও কারও ধারণা, ওবায়দুল কাদের পালানোর সুযোগ পাননি, তিনি দেশেই আছেন।
আত্মগোপনে থাকা নেতারাও ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান জানার চেষ্টা করছেন। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য ওবায়দুল কাদেরকে দুষছেন। এজন্য ভারতে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে নেতাদের দেখা হলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান পলাতক কয়েকজন নেতা। ইতোমধ্যে রোষানলের শিকার হয়ে নাজেহাল হয়েছেন ভারতে পলাতক একজন সাবেক মন্ত্রী। তাঁর বাড়ি কুমিল্লায়।

মৃত্যু ও গণপিটুনি
ভারতে পালাতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না। তিনি সিলেটের কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাওয়ার পর গত ২৪ আগস্ট মারা যান। কেউ কেউ পিটুনির শিকার হচ্ছেন। ২৩ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় আটক হন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এর আগে তাঁকে সীমান্তের ওপারে মারধরের অভিযোগ করেন তিনি।সমকাল

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions