ঘণ্টায় ৩৫ ডেঙ্গু রোগী আসছেন হাসপাতালে

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ৩৭ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন ২২ বছর বয়সী রাসেল মিয়া। গত তিন দিন আগে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। ধানমণ্ডিস্থ হাসপাতালটির ৫ তলায় মেডিসিন এক নম্বর ওয়ার্ডের বি-৬ সিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন এই ডেঙ্গু রোগী। পেশায় একজন শিক্ষার্থী। তিনি জানান, তার বাসা মোহাম্মদপুর সাত মসজিদ হাউজিংয়ে। এই এলাকায় বেশির ভাগ বাড়িই বর্তমানে নির্মাণাধীন। এতে প্রচুর মশা। কিন্তু মশা নিধনের তৎপরতা খুবই কম। একই ওয়ার্ডে ১২ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছে আরেক ডেঙ্গু রোগী মকসুদুল ইসলাম। তিনি জানান, ডেঙ্গু জ্বর আক্রান্ত হয়ে গত তিনদিন ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। শরীর খুবই দুর্বল। মাথাব্যথা। এই ওয়ার্ডের ৫৫ বছর বয়সী আরেক ডেঙ্গু রোগী স্বপন জানান, তিনি নিউমার্কেট এলাকায় থাকেন। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর তার দ্রুত প্লাটিলেট কমে যায়। রোগীর স্ত্রী জানান, একপর্যায়ে রোগীকে ৮ দিন আইসিইউ সার্পোট দিতে হয়েছে। এখনো শরীর খুবই দুর্বল। এই ওয়ার্ডটির একজন স্বাস্থ্যকর্মী জানান, ওয়ার্ডটিতে ১৪টি বেড রয়েছে। ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী।

শুধু এই ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু রোগী এমন নয়, মেডিসিন ওয়ার্ড ছাড়িয়ে গাইনি ও সার্জারি ওয়ার্ডেও ডেঙ্গু ভর্তি করতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। গতকাল সরজমিন হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের একজন স্থাস্থ্যকর্মী মানবজমিনকে জানান, ২০/৩০ মিনিট পরপর ডেঙ্গু রোগী আসছেন জরুরি বিভাগে। রোগীর অবস্থা খারাপ দেখলে চিকিৎসকরা ভর্তির পরামর্শ দেন। বাকিরা ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বাসায় চলে যান। এই কর্মী বলেন, জরুরি বিভাগ দিয়ে এখন যত রোগী আসছে তার ৯০ ভাগই ডেঙ্গু রোগী। এসব রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে বলেও জানান তিনি। জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক রোকনুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, তিনি বেলা আড়াই থেকে ডিউটিতে এসেছেন। তারপর দুই ঘণ্টায় ৬ জন ডেঙ্গু রোগী এসেছেন। বেশির ভাগ রোগী মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, জিগাতলা, আটিবাজার থেকে আসছে তাদের হাসপাতালে।

এদিকে, সারা দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যু বাড়ছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুতে চলতি বছরের মধ্যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে সেপ্টেম্বর মাস। সেপ্টেম্বর মাসেই মারা গেছেন ৬০ জন। ডেঙ্গু আক্রান্তে পুরুষরা বেশি হলেও মৃত্যুতে নারীরা বেশি। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গতে নারীরা আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হলে হাসপাতালে দেরিতে যান। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা তাদের বেশি।

২৬শে সেপ্টেম্বরের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ঘণ্টায় ৩৫ রোগী আসছেন হাসপাতালে। এ পর্যন্ত চলতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৩ জনে। মোট মৃত্যুর মধ্যে ৫২ দশশিক ৪ শতাংশ নারী এবং ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ পুরুষ। এ ছাড়া এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৭০৫ জন। আক্রান্তের মধ্যে ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ নারী রয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মশার প্রজনন ধ্বংস কার্যক্রম ভাটা পড়ায় পরিস্থিতি আবারো ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবও সে কথাই বলছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৫৫ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৪ জন। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ৩৩৯, মৃত্যু ৩ জন। মার্চে আক্রান্ত ৩১১, মৃত্যু ৫ জন। এপ্রিলে আক্রান্ত ৫০৪, মৃত্যু ২ জন। মে মাসে আক্রান্ত ৬৪৪ জন এবং মারা গেছেন ১২ জন। জুনে আক্রান্ত ৭৯৮ এবাং মৃত্যু ৮ জন। জুলাইয়ে আক্রান্ত ২ হাজার ৬৬৯ জন, মৃত্যু ১২ জন। আগস্টে আক্রান্ত ৬ হাজার ৫২১ জন এবং মারা গেছেন ২৭ জন। সেপ্টেম্বরের ২৭ দিনে চলতি বছরের রেকর্ড পরিমাণ আক্রান্ত ১৪ হাজার ৮৬৪ জন এবং মারা গেছেন ৬০ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয় মূলত বর্ষাকালে। আগস্ট থেকে বাড়তে থাকে এর ভয়াবহতা। কিন্তু চলতি বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি শুরু হয়। এতে এডিস মশারা তাদের প্রজননে উপযুক্ত আবহাওয়া পেয়ে গেছে বর্ষার আগেই। এখনো এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে ডেঙ্গুর প্রজননস্থল ধ্বংসে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন তারা। একইসঙ্গে আবহাওয়ার তারতম্যও সমানভাবে দায়ী উল্লেখ করে তারা বলছেন, এক্ষুণি এডিসের জীবাণুবাহী মশার প্রজননস্থল ধ্বংস না করতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

কেন ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এ বছরের শুরু থেকে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা করা হয়েছিল। মশার ঘনত্বের কথা বলা হয়েছিল। এডিসের প্রজনন ধ্বংসে সতর্কতা ও করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজগুলো সেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। এজন্য পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এডিসের প্রজনন ধ্বংসে এখনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আগামী মাসে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তিনি বলেন, বৃষ্টি ও তাপমাত্রার কারণেও এডিস মশা বেড়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঠিক সময়ে বিষয়টিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ছিল।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন ডেঙ্গু প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক প্রবন্ধে বলেছেন, গত বছরের তুলনায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এ বছর বেশি না হলেও মৃত্যুহার বেশি। সুতরাং ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কিংবা ডেঙ্গু আক্রান্তের হার কমে আসছে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। এ বছর এখন পর্যন্ত একদিকে প্রচণ্ড তাপ, অন্যদিকে প্রচণ্ড বৃষ্টি। এ রকম উত্তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এডিস মশার ডিম ও প্রজনন খুব দ্রুত হয়। বৃষ্টি হচ্ছে, আবার গরম পড়ছে। কাজেই একদিকে মশা নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় আমাদের জোর দিতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ও পরবর্তী সময়ে সিটি করপোরেশনের কর্মসূচি বন্ধ ছিল। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার সব রকম স্থানীয় সরকার ভেঙে দিয়েছে। বর্তমানে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, তাতে জনগণকে সম্পৃক্ত করার কোনো তৎপরতা এখনো দেখছি না।মানবজমিন

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions