অর্থ লোপাটে বাপ-বেটার মহারেকর্ড

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ৪১ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ বেশ কয়েকটি দপ্তরে নিয়োগ বাণিজ্যে ঘুষ হিসেবে বস্তায় বস্তায় টাকা নিতেন তিনি। দেশ থেকে পাচার করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা।

আসাদুজ্জামান খান, তাঁর পরিবার এবং সিন্ডিকেটের সদস্যদের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের অর্থ সঞ্চয় ও পাচারের তথ্য মিলছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকা রাখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে হত্যার অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দুর্নীতির সব ধরনের তথ্য অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ১৫ আগস্ট দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংস্থাটির উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম জানান।

অভিযোগের অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ সদর দপ্তর ও অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি) তাঁর দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক তথ্য বেরিয়ে আসছে। তিনি মাফিয়াদের গডফাদার ছিলেন।
তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল একটি বড় দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। তিনিসহ এই সিন্ডিকেটের সব সদস্য এখন গাঢাকা দিয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত নিত এই চক্র। এ ছাড়া পুলিশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে এক থেকে তিন কোটি টাকা নিত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়ন্ত্রণাধীন এই সিন্ডিকেট।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান নবম জাতীয় সংসদে ঢাকা-১১ এবং দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদে ঢাকা-১২ আসন থেকে নির্বাচিত হন।

তিনি এ সময় পর্যন্ত টানা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর প্রভাবের কারণে দলীয় অন্যরা এই মন্ত্রণালয় পাননি।

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, দুদকের অনুসন্ধানে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ব্যাংকে নগদ অর্থ, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। অনুসন্ধানে তাঁদের ব্যাংক হিসাবেই শতকোটি টাকার বেশি অর্থের সন্ধান মিলেছে। এ ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে বস্তায় বস্তায় কোটি কোটি টাকা আদায় করার অভিযোগ ছিল।

অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারেন, সে কারণে আদালতের অনুমতিক্রমে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাঁর স্ত্রী, দুই সন্তান এবং মন্ত্রীর পিএস, এপিএসসহ ওই ১০ ব্যক্তিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে রামাদা ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা এই প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করেও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ছাড়া রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজির কোটি কোটি টাকার ভাগ পেতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া তথ্য

প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানতে পেরেছেন, সাবেক এক স্বরাষ্ট্রসচিবের মাধ্যমে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতেন না। জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে এক থেকে তিন কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

এই চক্রের অন্যরা হলেন তাঁর সাবেক পিএস অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশিদ বিশ্বাস, যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু।

দুদকের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, মন্ত্রণালয়ের সব ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ঝুঁকি এড়াতে দুর্নীতির টাকাগুলো তিনি বিভিন্ন সময়ে দেশের বাইরে পাঠিয়েছেন। কক্সবাজারে হোটেলের পাশাপাশি জমিও রয়েছে তাঁর।

তদন্তে উঠে আসছে, ২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান পুলিশের সাবেক ডিআইজি মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম। সে সময় পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে মোল্ল্যা নজরুলকে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। এ ছাড়া এনজিওর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা ‘এনওসি’ দিতে গিয়ে প্রতি সংস্থা থেকে ৮০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা দিতে হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের দরবারে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি উন্নয়ন সংস্থার এনওসি নিতে গেলে বিপত্তি শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

এর আগে পুলিশের বিশেষ শাখা, জেলা প্রশাসক, এনএসআই ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে। তার পরও অদৃশ্য কারণে ফাইলটি মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় মন্ত্রণালয়ে। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীকে ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ফার্মগেট এলাকায় কামালের বাসার সামনে টাকার ব্যাগটি দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের এক সদস্যের কাছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে কোনো সার্কুলার হলেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি তালিকা পাঠানো হতো। সে অনুযায়ী তাঁদের নিয়োগ দিতে ফায়ার সার্ভিসকে বাধ্য করতেন সাবেক এই মন্ত্রী। ২০২৩ সালের ২ অক্টোবর ৫৩৫ জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এর মধ্যে ছিলেন ৪৩৬ জন পুরুষ, ১৫ জন নারী ফায়ারফাইটার এবং ৮৪ জন গাড়িচালক।

নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। নিয়োগের জন্য জনপ্রতি আট থেকে ১২ লাখ টাকা নিত কামাল-হারুন সিন্ডিকেট।

এসআই নিয়োগে শতকোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পুলিশের এসআই ও সার্জেন্ট পদে নিয়োগের মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি গোপন প্রতিবেদন জমা হয়েছে।

প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানতে পেরেছেন, এই নিয়োগ দুর্নীতিতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে একেকজন প্রার্থীর কাছ থেকে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে পছন্দের তালিকা তৈরি করা হয়। আর চাহিদামতো ঘুষ না দিলে তাঁকে ভাইভায় ফেল করিয়ে দেওয়া হতো।

সার্বিক বিষয়ে পুলিশের নতুন নিয়োগ পাওয়া আইজিপি ময়নুল ইসলাম বলেন, পুলিশকে এখন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। গত ১৫ বছরে পুলিশের অনেক ক্ষতি হয়েছে।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরের সিপিইউ পরীক্ষা করবে দুদক

দুর্নীতির তথ্য পেতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দপ্তরে দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটারের সিপিইউ ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করার অনুমতি পেয়েছে দুদক।

দুদক কৌঁসুলি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর জানান, দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত এই আদেশ দিয়েছেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ আগস্ট দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটের দিকে সচিবালয়ের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর এপিএস মনির হোসেনের ব্যবহৃত ৩০৪ নম্বর রুম থেকে তাঁর ব্যবহৃত কম্পিউটারের সিপিইউটি জব্দ করা হয়।

আসাদুজ্জামান খান এবং তাঁর পরিবারের ৩২০ কোটি টাকা দুর্নীতির প্রমাণ

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাঁর পরিবারের নামে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। সংস্থাটির অনুসন্ধানে আরো ২০০ কোটি টাকার বেশি মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটির অনুসন্ধান টিম। সব মিলিয়ে আপাতত ৩০০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে আসাদুজ্জামান কামাল, তাঁর স্ত্রী লুত্ফুল তাহমিনা খান, তাঁর ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান, মেয়ে সোফিয়া তাসনিম খান এবং সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেনকে আসামি করে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, দুদক টিম ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে অন্তত ২০০ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। আপাতত এসব কারণেই মামলার সুপারিশ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এই দুর্নীতির বিষয়ে একটি সুষ্ঠু তদন্ত চলছে। সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিদেশে অর্থপাচারের বিষয়ে তদন্ত করছেন।কালের কন্ঠ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions