ডেস্ক রির্পোট:- আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরে পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ থামছে না। সেনাসদস্য, পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের যৌথ টহল সত্ত্বেও কিছু কারখানা বন্ধ রাখা হচ্ছে নিরাপত্তার অজুহাতে। পোশাক শিল্প-মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে সব পোশাক কারখানা চালু করার ঘোষণা দেয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে তিন অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে প্রায় ২৫০টির মতো পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বড় কোনো কারণ ছাড়া এই অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টার পেছনে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত বলে শিল্পসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। পোশাক খাতকে পেছনে নেয়া এবং দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করতে এমনটা করা হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।
এদিকে গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে আসবে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের অসন্তোষ নিয়ে প্রতিদিন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর উপদেষ্টারা বসছি। আমরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি দেখছি। যেসব সমস্যা আছে সেগুলো সমাধানের জন্য একটি পর্যালোচনা কমিটি শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে করে দেয়া হয়েছে। আমরা শ্রমিক ভাইদের আহ্বান জানাবো, যেকোনো অভিযোগ যেগুলো নিষ্পত্তিযোগ্য তারা শ্রম আইনের মধ্যে সমাধান করতে পারবেন-সেগুলো সেখানে দেয়ার জন্য বলেছি। আশাকরি দ্রুত সময়ের মধ্যে যে শ্রমিক অসন্তোষ আছে সেটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। শ্রমিকদের যেসব সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান দিতে পারবো।
জানা গেছে, সরকার পরিবর্তনের পর শিল্পাঞ্চলগুলোতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংকট শুরু হলেও শ্রমিকদের বেশকিছু ন্যায্য দাবিও ছিল। তবে কেউ কেউ এর নেপথ্য কারণ নতুন বাংলাদেশ গঠনের সময়টাকে অস্থির করার চেষ্টা বলেও মনে করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, এভাবে চলতে থাকলে বৈশ্বিক ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে তাদের কার্যাদেশ অন্য দেশে স্থানান্তর করতে পারে। এমন ঘটনা হলে মালিক-শ্রমিক উভয়ের জন্য নেতিবাচক। সামগ্রিকভাবে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মূলত পোশাক খাত নিয়ে দেশি ও বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এর মধ্যে রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে। এ সংকট দ্রুত শক্তভাবে প্রতিহত করতে না পারলে দেশের পুরো পোশাক শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
শ্রমিক নেতারা বলেন, কারখানাভিত্তিক কিছু সমস্যা আছে; যেমন, হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল, নাইট অ্যালাউন্স বাড়ানো, মজুরি সমন্বয় এবং মাতৃত্বকালীল সময়ে ভারী কাজ থেকে মুক্তি না দেয়া।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বস্ত্র ও পোশাক খাত ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়ে গেছে। কারখানাগুলোর সামনে ৫০ থেকে ১০০ জনের বহিরাগত দল এসে উত্তেজনা তৈরি করছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুরসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের পোশাক কারখানাতে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে বিদেশি ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিটিএমএ।
পুলিশ ও কারখানা মালিক সূত্র জানায়, গত কয়েক দিনের টানা শ্রমিক অসন্তোষের মুখে ১০ই সেপ্টেম্বর থেকে কারখানাগুলোতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে শুরু করে মালিকপক্ষ। জানা গেছে, প্রথমে মজুরি ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে মাঠে নামেন শ্রমিকরা। পরে তারা চাকরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার দাবি জানান। পাশাপাশি তারা বেকারদের জন্য চাকরি ও কর্মচ্যুতদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি তোলেন। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শ্রমিকদের দাবির মধ্যে ঢুকে গেছে রাজনীতি। সাধারণ শ্রমিকদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে একটি শ্রেণি।
মালিকরা বলছে, শ্রমিকদের একটা দাবি মেনে নেয়ার পর আরেকটা দাবি নিয়ে রাস্তায় নামছে। কাদের ইন্ধনে তারা নিজেদের রুটি-রুজির জায়গা নষ্ট করছে, সেটাই এখন খুঁজে বের করার সময় এসেছে। তবে এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রকৃত শ্রমিকরা জড়িত নয় বলেও দাবি করছেন কারখানা মালিক ও শ্রমিক নেতারা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গত দুই মাসে মিনিমাম (কমপক্ষে) ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অর্ডার কমেছে। এ অর্ডারগুলো বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে চলে গেছে। আন্দোলনের সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বায়াররা (ক্রেতা) আমাদের পায়নি। বায়াররা শঙ্কিত ছিল শিপমেন্ট ঠিকমতো হবে কিনা। ফলে অন্য দেশে অর্ডার চলে গেছে। এখন লেট উইন্টার আর সামার নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমেরিকা এবং ইউরোপের সঙ্গে জিএসপি সুবিধা ও ডিউটি ফ্রি অ্যাকসেস নেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। এসব সুবিধা যোগ হলে অর্ডার বেড়ে যাবে।
বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, গত এক মাসে দেশে নানারকম ঝামেলায় অর্ডার কিছুটা কমেছে। কিছু অর্ডার চলে গেছে। বন্যার সময় রাস্তা বন্ধ ছিল ৪ থেকে ৫ দিন। এ সময় আমরা রপ্তানি করতে পারিনি। বিজিএমইএ’র সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালে শ্রমিক আন্দোলনে মোট প্রায় ২৫০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তবে ওই আন্দোলনে শ্রমিকদের সংশ্লিষ্টতা ছিল না এবং বহিরাগতদের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল বলে তিনি জানান।
বিজিএমইএ’র জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে পোশাকশিল্পকে ধ্বংস করতে চক্রান্ত শুরু করেছে। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিতে শ্রমিক অসন্তোষের পুরনো নাটক মঞ্চস্থ করতে চাচ্ছে। এ ধরনের দুর্বৃত্তদের দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশন সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, কোনো কারখানা ভাঙচুর ও লুটপাটের সঙ্গে কোনো শ্রমিকের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। কোনো শ্রমিক এই কাজ করতে পারে না। মাঝখানে স্বার্থান্বেষীরা অরাজকতা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে চায়।
সাভারের আশুলিয়ায় গত কয়েকদিন ধরে পোশাক শ্রমিকদের নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের জেরে মালিকপক্ষের সঙ্গে সুরাহা না হওয়ায় আশুলিয়ায় ২১৯টি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে ৮৬টি কারখানা শ্রম আইনের মোতাবেক বন্ধ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া বাকি ১৩৩টি কারখানায় দেয়া হয়েছে সাধারণ ছুটি। তবে কোথাও কোনো ধরনের সড়ক অবরোধ বা বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়নি। শিল্পাঞ্চলের অন্যান্য কারখানাসহ ঢাকা ইপিজেডের কারখানাগুলো চালু রয়েছে।
গাজীপুরে গত কয়েকদিনের শ্রমিক অসন্তোষের জেরে ৮টি পোশাক কারখানা ঘোষণা দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়াও সাধারণ ছুটি দেয়া হয়েছে ৩০টি পোশাক কারখানা। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে উৎপাদন কার্যক্রম চলেনি এসব কারখানায়। তবে জেলা ও মহানগরের কয়েক হাজার কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। শিল্পকারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে শিল্প পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর টহল অব্যাহত রয়েছে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারওয়ার আলম গণমাধ্যমকে জানান, গত কয়েকদিনের শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে ও ঝামেলা এড়াতে মহানগর ও মহানগরের বাইরে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় নায়াগ্রা টেক্সটাইল, এসএম নিটওয়্যার লিমিটেডসহ সবমিলিয়ে ৮টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও ৩০ কারখানা ছুটি রয়েছে। শিল্প পুলিশ সবসময় কারখানাগুলোর তদারকি করছেন।
কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, যেসব কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে সেসব ছাড়া বাকি সব কারখানায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিরাজ করছে। কারখানাগুলোতে উৎপাদন কার্যক্রমও স্বাভাবিক রয়েছে। এদিকে সকালে গাজীপুরে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানায় বেতন, মাতৃকালীন ছুটিসহ এবং চিকিৎসাজনিত ছুটির দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। আন্দোলনের মুখে কর্তৃপক্ষ ওই কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করলেও শ্রমিকরা কারখানার গেটে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে। গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর বেক্সিমকো জোনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. গোলাম মোর্শেদ জানান, বৃহস্পতিবার সকালে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের মেইন গেটের সামনে কিছু সংখ্যক শ্রমিক অবস্থান নেয়, পরে তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। তবে কাশিমপুর ও কোনাবাড়ী এলাকার বেশির ভাগ কারখানা স্বাভাবিকভাবেই চলছিল বলেও জানান তিনি।