ইসলামী ব্যাংক থেকে সরে যাচ্ছেন এস আলমের কর্মকর্তারা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০২৪
  • ৯০ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বড় পরিবর্তন শুরু হয়েছে ইসলামী ব্যাংকে। দীর্ঘদিন দাপটের সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার পর হঠাৎ ইসলামী ব্যাংক থেকে বিদায় নিচ্ছেন এস আলম গ্রুপের নিয়োগপ্রাপ্তরা। এরইমধ্যে শীর্ষ পদে থাকা অন্তত চার জন কর্মকর্তাকে ব্যাংক থেকে চলে যেতে হচ্ছে। এদের মধ্যে ব্যাংকের এএমডি মুহাম্মদ কায়সার আলী বুধবার (৭ আগস্ট) পদত্যাগ করেছেন। এছাড়া ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) মো. আকিজ উদ্দিন চৌধুরী ও মিফতাহ উদ্দিন গত দুদিন ধরে ব্যাংকে আসছেন না।

নাম প্রকাশ না করে ব্যাংকটির শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, এস আলম গ্রুপের হয়ে যেসব কর্মকর্তা ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ পদে ছিলেন, তারা এখন ভাগতে শুরু করেছেন। আজকে বুধবার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল মাওলার কাছে একজন পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

এর আগে ব্যাংকের আরেক ডিএমডি রেজাউর রহমানকে মারধর করেছে আইবিবিএলের লোকজন। এছাড়া এস আলমের ‘বিশেষ কৃপায়’ প্রমোশন পাওয়া আরও অন্তত চার-পাঁচ জনকে মারধর করেছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।

এদিকে ইসলামী ব্যাংক থেকে যাদের জোর করে ও বাধ্যতামূলক চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, তাদের আবার ফেরার সুযোগ দিতে যাচ্ছে ব্যাংকটি। ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকের সহযোগী সব প্রতিষ্ঠান থেকে জোর করে চাকরিচ্যুতদের স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানে ফেরানোর জন্য আদেশ জারি করেছে ব্যাংকটির প্রশাসন।

মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) জারি করা আদেশে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন (আইবিএফ) এবং আইবিএফ কর্তৃক পরিচালিত সব প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে স্বেচ্ছায়/জোরপূর্বক/বাধ্যতামূলকভাবে যেসব জনবলকে অব্যাহতি প্রদান, অথবা গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে, তাদের সবার বরাবর পাঠানো পত্র বাতিল করা হলো। অর্থাৎ তাদের ওই তারিখ থেকে পুনর্বহাল করা হলো। অনতিবিলম্বে এই ব্যক্তিদের চিঠি ইস্যু করে কাজে যোগদানের জন্য অবহিত করা হবে।

এই আদেশে সই করেছেন ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ও ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতালগুলোর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার মোহাম্মদ আলী।

এদিকে অচিরেই ইসলামী ব্যাংকে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা ব্যাংকটিতে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের সিবিএ নেতা আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালের পর থেকে পরীক্ষা ছাড়াই অনিয়মের মাধ্যমে যেসব নিয়োগ হয়েছে, সেসব নিয়োগ বাতিল করা হবে। একইসঙ্গে ওই সময়ের পরে যাদের চাকরি অবৈধভাবে বাতিল করা হয়েছে, তাদের চাকরি পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া গত সাত বছরে যারা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের যথাযথভাবে পদোন্নতি দেওয়া হবে।’

জামায়াতের ইসলামীর একটি প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। জামায়াত নেতারা ব্যাংকটিকে আগের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করার পরামর্শ দেন। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল মাওলা তাতে সায় দিয়েছেন বলে জানান ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট সূত্র।

তবে এ ব্যাপারে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংক খোলার প্রথম দিনেই বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকে অস্থিরতা শুরু হয়। মঙ্গলবার রাজধানীর দিলকুশায় ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু কর্নার ভাঙচুর করেছেন বিক্ষুব্ধ কিছু কর্মকর্তা। পাশাপাশি মানবসম্পদ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তাকে মারধরও করা হয়েছে। এ ঘটনার পর ব্যাংকের সিবিএ নেতা আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের পরে যত নির্বাহী এসেছেন, তারা আর ব্যাংকে ঢুকতে পারবেন না।

ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তনের পর গত সাত বছরে অনেক কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক জুনিয়র কর্মকর্তাকে সিনিয়র পদে বসানো হয়। এছাড়া ব্যাংকটি থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে বলে মালিকদের একটি পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।

দেশে শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড সবচেয়ে বড়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটির পর্ষদে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই ছিলেন। তাদের মধ্য থেকেই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য নীতিনির্ধারক পদে নিয়োগ দেওয়া হতো। নির্বাহী ও নিচের পর্যায়েও ওই ঘরানার জনশক্তিই বেশি। ফলে ব্যাংকটি পরিচালিত হতো জামায়াতের আদর্শ নিয়ে।

জামায়াতে ইসলামীর প্রচেষ্টায় ১৯৮৩ সালে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংক। এর স্লোগান ছিল ‘কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার পথপ্রদর্শক’। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পসহ রফতানিমুখী শিল্প এবং দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের মতো নতুন নতুন খাতে ব্যাংকটি আর্থিক সেবার দুয়ার খুলেছিল। বিভিন্ন স্থানীয় শিল্প ও এসএমই দাঁড়িয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ঋণের ওপর। প্রতিষ্ঠাকালে এই বেসরকারি ব্যাংকের ৭০ শতাংশ পুঁজি জোগান দিয়েছিলেন বিদেশিরা। এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটিকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর অনেকটা ঝুঁকিতে পড়েছে।

মালিকানা বদলের প্রক্রিয়া যেভাবে শুরু হয়

২০১৫ সালে জঙ্গি অর্থায়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতায় অর্থায়নের অভিযোগ তুলে জামায়াতের ইসলামীর কাছ থেকে ব্যাংকটির মালিকানা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দফতরের আওতাধীন প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও কাজে লাগানো হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে জনস্বার্থ, আমানতকারীদের স্বার্থসংরক্ষণ ও ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ প্রতিরোধে ইসলামী ব্যাংকের ওপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকের দ্বিতীয় পর্যায়ের শীর্ষ নির্বাহী উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নিয়োগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। ওই সময় বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ডিএমডি নুরুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ইসলামী ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন ৫ জন। তাদের সবাইকে ২০১৬ সালে ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়া হয়। বসানো হয় শামীম আফজালসহ সরকারের পছন্দের চার জন স্বতন্ত্র পরিচালককে। শুধু তাই নয়, ওই বছরের শুরুতে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ জাহেরকে বের দেওয়া হয়। তার স্থানে বসানো হয় মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী মোস্তফা আনোয়ারকে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বতন্ত্র পরিচালক ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এন আর এম বোরহান উদ্দিনের বিরুদ্ধে রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলার পর এন আর এম বোরহান উদ্দিনকে ব্যাংক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

মালিকানা পুরোপুরি বদলে যায় ২০১৭ সালে

রাজধানীর র‍্যাডিসন হোটেলে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ব্যাংকটির তখনকার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল মান্নানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ঘটানো হয় অপ্রীতিকর ঘটনা। পরিবর্তনের কারণ হিসেবে ব্যাংকটিকে জামায়াতমুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। ওই দিন নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক সচিব আরাস্তু খান ও এমডি পদে দায়িত্বে আসেন চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি আবদুল হামিদ মিঞা। বাজার থেকে নতুন শেয়ার কিনে ব্যাংকটির এসব পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে এস আলম গ্রুপ। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার এক বছরের মধ্যে কয়েক দফায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন হয়।বাংলা ট্রিবিউন

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions